১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশ
নামক রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে শরীফ কমিশনের
নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন
পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় অপ্রাসঙ্গিক ছিল। এগুলোর মধ্যে উচ্চ শিক্ষা
সংকোচন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছরে বছরে পরীক্ষা ব্যবস্থা, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি
পাস কোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধি প্রস্তাবনা অন্যতম। পরবর্তী ছাত্র আদোলনে এসব
নীতিমালা বন্ধ করো দেওয়া হয়। বাষট্টি সালের শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল
শিক্ষার সংকোচন অবস্থা থেকে মুক্তি এবং শিক্ষাকে সার্বজনীন করা।
সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও ফলাফলের কার্যকারিতা
কেমন তার উপর দাঁড়িয়ে আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা যায়। বর্তমান সময়ে শিক্ষা
চলছে ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। যেখানে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো একই ধারার শিক্ষানীতি দাবি করে
আসলেও সরকার এ বিষয়ে কর্ণপাতে নারাজ। ভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে
রাষ্ট্রীয় যে মূল ধারার শিক্ষানীতি সেখানে রয়েছে এক বিশাল গলদ। এই গলদের মাশুল গুনতে
হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এবং একূল না অকূল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন
ভাষাভাষী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের।
ঠিক কেমন জটিল প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হচ্ছে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের
এই আলোচনায় সরাসরি যাওয়া যাক। বিভিন্ন প্রতিবেদনের দিকে নজর দিলে আপনি কিছু সমীকরণ
দেখতে পাবেন যেখানে দেখা যাবে বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ১৬৬টি চা বাগান রয়েছে।
লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় চা রপ্তানিতে বাংলাদেশের
অবস্থান ৯ম এবং নানা জটিলতার মধ্যেও চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো পর্যায়ে। কিন্তু
যাদের শ্রমের বিনিময়ে এই উৎপাদন প্রক্রিয়া তাদের বা সেই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষার
অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।
শ্রম আইনের (২০০৬) ৯৫ নম্বর ধারার (খ) অনুচ্ছেদে বলা
হচ্ছে, চা বাগানের শ্রমিকদের ছয় থেকে ১২ বছরের সন্তান যদি ২৫ জনের বেশি হয় তাহলে উক্ত
বাগানে ওই সকল শিশুদের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ৯৭ নম্বর ধারায় চা শ্রমিকদের
সহজভাবে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস প্রাপ্তির সুবিধার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু বাস্তব
চিত্র কি বলছে সেদিকে যদি দেখি তবে সেখানে এই সমীকরণের বিপরীতে রয়েছে মাত্র ১০টি প্রাথমিক
বিদ্যালয় এবং ৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অথচ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শ্রম আইন বা প্রাথমিক
শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সারাদেশ ব্যাপী পরিচালিত বহুল আলোচিত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ
প্রক্রিয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। এর বাইরেও রয়েছে স্বাস্থ্য
এবং মানসিক স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরিসংখ্যান, যেখানে ৫-১৭ বছর শিশুদের মধ্যে ৫০ ভাগ শিশুই খর্বকায় মানে
বয়স এবং স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার তুলনায় নানান শারীরিক দুর্বল অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন সমস্যায়
ভুগছে।
এছাড়াও সবথেকে আশঙ্কাজনক পরিসংখ্যান হলো সারাদেশে
যেখানে শিশু শ্রমের পরিমাণ ৬ কি ৭ শতাংশ সেখানে চা বাগানে এর পরিমাণ ২০ শতাংশ। ফলে
এই জনগোষ্ঠীর শিশুদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে
আসার জন্য যে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজন তা থেকে বঞ্চিত হয়ে পিছিয়ে পড়ছে।
এছাড়াও আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য যে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে তা থেকেও তাঁরা
বঞ্চিত হচ্ছে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় গেজেটভূক্ত না হওয়ার কারণে। একটি দুঃখ জাগানিয়া তথ্য,
১৬৬ বছরে চা জনগোষ্ঠীদের এই বাংলার ইতিহাসে মাত্র ৪০ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন সরকারি
প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এ হলো মোটামুটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় চা জনগোষ্ঠীদের
শিক্ষাগত অবস্থা।
এই পরিসংখ্যান গুলো শুধুমাত্র চা জনগোষ্ঠীদের নিয়ে
হলেও এই চিত্র সারাদেশে বসবাসরত বাকি আদিবাসী জনগোষ্ঠীদেরও। আমরা যদি সমতলে বসবাসরত
গারো সাঁওতাল মুন্ডা, মাহালী, ওঁরাও হাজংসহ ৩৫টির মতো জনগোষ্ঠীর প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায়
অবস্থানগত জায়গা দেখি তাহলে সেখানে দেখতে পাবো স্কুল সংকট, শিক্ষক সংকট, ভাষাগত জটিলতা
এইসব নানাবিধ সমস্যায় আদিবাসী শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষায়
পিছিয়ে যাচ্ছে।
আদিবাসীদের শিক্ষার এই প্রতিবন্ধকতার পেছনে শুধু রাষ্ট্রের
দায়বদ্ধতার অভাব নাকি খোদ রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পলিসিও যুক্ত রয়েছে প্রসঙ্গের
খাতিরে এই বিষয়ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এই বিষয়ের উপর আলোচনা করতে গিয়ে স্পষ্ট
চোখ রাখতে হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে যেখানে পরগাছার মত করে পাহাড়ি জমি দখল করে
গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র, যার ফলে শুধু ভূমি হারানোর ফলে সরাসরিভাবে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা
প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হচ্ছে।
সাজেক সরকারি প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষিকার সাথে
আলাপকালে উঠে আসে অপরিকল্পিত পর্যটনের ফলে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা স্কুল বিমুখ হচ্ছে।
পাহাড়ি শিশুদের ২০ টাকা, ৩০ টাকায় পর্যটকদের গাইডার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং পর্যটন
কেন্দ্রের রাস্তা গুলোতে চিড়িয়াখানার জন্তুদের মতো করে পাহাড়ি শিশুদের দিকে ছুঁড়ে মারা
হয় চকলেট যার ফলে শিশু সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যমূলক এবং পর্যটকদের দাসত্বমূলক
আচরণের শিকার হচ্ছে পাহাড়ের আদিবাসী শিশুরা। কিশোর সময়ে মানসিক বিকাশকালে পক্ষপাতী
পলিসির ফাঁদে পরতে হচ্ছে পাহাড়ি শিশুদের।
আবার জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে কেমন বরাদ্দ এসেছে এসবের
দিকে নজর দিলে দেখতে পাবো গত ২০১৯- ২০ অর্থ বছরে তুলনায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে প্রস্তাবিত
বাজেটের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা বেড়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২৪
হাজার ৯৩৭ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা
শিক্ষা বিভাগের জন্য ৮ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।
বছরের পর বছর ধরে শিক্ষাখাতের বাজেটে আত্মতৃপ্তি ঢেঁকুর
তুললে চলে না। ঘুরে ফিরে মোট বাজেটের ১১-১২ শতাংশের মধ্যে বিদ্যমান যার হওয়ার কথা মোট
বাজেটের ২০ শতাংশ এবং মোট জিডিপির ৬ শতাংশ যেখানে আছে ২.০৯ শতাংশ। এর মাঝেও রয়েছে কিছু
শুভংকরের ফাঁকি, অর্থমন্ত্রী বলছেন, সরকারের
২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু এরমধ্যে
শিক্ষা বহির্ভূত খাতের বরাদ্দও আছে। যেহেতু বাজেট মন্ত্রণালয় ধরে হয় সেখানে শিক্ষা খাতে কেন আলাদা বরাদ্দ রাখা হবে না এই প্রশ্ন
রাখা যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, গত বছর থেকে সরকার বাজেট বরাদ্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের
সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকে যুক্ত
করে বরাদ্দের হিসাব করছে যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এছাড়াও শিক্ষা খাতের দুই তৃতীয়াংশ ব্যয় হচ্ছে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা
খাতে, আর মাত্র এক শতাংশ ব্যয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পেছনে।
২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট পেশ করা হয় সেখানে
আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকা যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিলো ৫০
কোটি টাকা। এত অল্প বাজেটে ৩০ লাখ জনগোষ্ঠীর অন্যান্য খাতের পাশাপাশি আলাদা ভাবে শিক্ষা
খাতে উন্নয়নের কতটুকু সুযোগ রয়েছে?
আইএলও কনভেশন আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী কনভেনশন
১৯৫৭ ও ১৯৮৯’র ষষ্ঠ অংশ অনুচ্ছেদ ২৮ এ বলা আছে, এই সকল জনগোষ্ঠীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা
নিশ্চিত করতে হবে এবং সকল প্রকার সহযোগিতা রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় পাঠদানের কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত চালু হয়েছে মাত্র
৬টি ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু দক্ষ শিক্ষকের অভাব, বাজেটের স্বল্পতা ইত্যাদি নানা
কারণে কচ্ছপ গতিতে আগাচ্ছে মাতৃভাষায় শিক্ষার পাঠ।
বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত চিম্বুকে ম্রোদের জমিতে
ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে যে সংকট রয়েছে, সেখানে কয়েকটি গ্রাম মিলেও
একটি সরকারি বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই বা আপনি যদি দেখেন সাজেকের স্থানীয়
আদিবাসী জনগোষ্ঠীদেও যেখানে ছোট ছোট শিশুরা প্লেকার্ড হাতে বলছে, ‘‘আমাদের মসজিদ চাই
না, স্কুল চাই’’। এ সকল প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা কতটা মৌলিক শিক্ষার সুযোগ
পাচ্ছে বা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে?
আলোচনার একটা বিশাল অংশ জুড়ে প্রতিবন্ধকতার কথা বলা
হলেও আমাদের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনার দিকে যথেষ্ট নজর দিতে হবে বা যে পদক্ষেপগুলো
রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত হলেও বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা সম্ভাবনার মুখ দেখবে। সম্ভাবনার কথা বলতে গেলেই প্রথমে ন্যাশন
স্ট্যাট এর ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের সকল জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি
নিশ্চিত করতে হবে। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় যে মূল প্রতিবন্ধকতা তা হলো নিজ মাতৃভাষায়
এবং নিজ নিজ সামাজিক সাংস্কৃতিক শিক্ষা নিশ্চিত না করা যার ফলে সম্ভাবনা দেখতে হলে
রাষ্ট্রকে ন্যাশনাল টাস্কফোর্স গঠন করে এই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি ২০১০’র শিক্ষানীতিতে যে সুবিধার কথা বলা হয়েছে সেই সুবিধা
গুলোকে অধিকারে রূপান্তর করতে হতে। দেশে যে ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষানীতি চালু রয়েছে
এই ব্যবস্থাকে ভেঙে একই ধারার শিক্ষা নীতিতে রূপান্তর করতে হবে। চাকরি, বাজার মুখী
বা পণ্য মুখী শিক্ষা না করে মানবিক এবং মৌলিক শিক্ষায় রূপান্তর করতে, আদিবাসী শিক্ষার্থীর
শিক্ষা নিশ্চিত করতে আলাদা গবেষণা প্রয়োজন, এদিকে রাষ্ট্রকে কড়া নজর দিতে হবে। সাথে
শিক্ষাখাতে আর্থিক বাজেট বৃদ্ধির পাশাপাশি সঠিক খাতে ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: প্রত্যয় নাফাক, সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন,
চবি সংসদ।