লেবিসন স্কুর গল্পগ্রন্থ দলছুট’র মোড়ক উন্মোচন

গারো কবিতা

কবি ও লেখক লেবিসন স্কুর প্রথম গল্পগ্রন্থ দলছুট’র মোড়ক উন্মোচন হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গারো বইমেলায় বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে বইটির মোড়ক উন্মোচন হয়।

মোড়ক উন্মোচনকালে তিউড়ি প্রকাশনীর কর্ণধার লেখক মাইবম সাধন, ভারত বিচিত্রার সম্পাদক অরবিন্দ চক্রবর্তী, লেখক পিটারসন কুবি, কবি মিঠুন রাকসাম, ঢাকা ওয়ানগালার নকমা শুভজিৎ সাংমা, কবি নিগূঢ় ম্রং, ছাত্রনেতা তেনজিং দিব্রা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বইটির লেখক লেবিসন স্কু বলেন, বইটিতে গারো আদিবাসীদের সমাজব্যবস্থা, লোক-ঐতিহ্য, গারো মিথ, জাতিত্ব হারানোর হাহাকার, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত অসহায় প্রেম-দ্রোহের গল্প স্থান পেয়েছে।

যোগ করে তিনি আরো বলেন, আমি কবিতা লিখি, দলছুট আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ। জানিনা কেমন লিখেছি, মূল্যায়নের দায়িত্ব পাঠকের কাছেই তুলে দিলাম।

বইটি সম্পর্কে তরুণ কবি নিগূঢ় ম্রং জনজাতির কণ্ঠকে বলেন, গল্পগ্রন্থ দলছুট-এ গারো জীবনের নানা অভিজ্ঞতার গল্প স্থান পেয়েছে। আশা করছি বইটি পাঠকমহলে সমাদৃত হবে।  

বইটি রাজধানীর কালাচাঁদপুর শিশু মালঞ্চ স্কুল মাঠ প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী চলমান গারো বইমেলা থেকে সংগ্রহ করা যাবে। গত ২২ মার্চ থেকে চলা গারো বইমেলা আগামী ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে।

গারো জাতিসত্তার অন্যতম কবি ও লেখক লেবিসন স্কুর বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার মধুকুড়া গ্রামে। লেখকের অন্যান্য গ্রন্থগুলো হল— মানুষ এক অদ্ভূত সাঁড়াশি অনুবাদক, প্রান্তিক স্বর, বুকের ডালে ঝুলিয়ে দেবো নরম নদী। 

বাসাবোতে বিনামূল্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ইফতার বিতরণ

বাসাবোতে বিনামূল্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ইফতার বিতরণ

ভিন্ন ধর্মের হয়েও মুসলমানদের জন্য প্রতিদিন ইফতারের ব্যবস্থা করে সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করেছেন রাজধানীর সবুজবাগের ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের ভিক্ষুরা। এই বিহারটির ভিক্ষুরা প্রতিবছর বিনামূল্যে ইফতার বিতরণ করেন।

বিহার কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, যারা এখানে ইফতার নিতে আসেন তাদের অধিকাংশই দুস্থ নারী। এছাড়া অসহায় রোজাদারসহ রিকশাচালক ও দিনমজুররাও আসেন ইফতার নিতে। মানুষকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে মানুষে-মানুষে বন্ধুত্ব ও প্রীতি বাড়বে। একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ানোর জন্যই এই ইফতার বিতরণের উদ্যোগ।

ইফতার বিতরণের এই উদ্যোগটি ২০১৩ সালে শুরু হয়। মাঝে করোনা মহামারীর কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর ২০২৩ সাল থেকে ফের চালু হয়।

এবারও পহেলা রোজা থেকেই সম্প্রীতির এই ইফতার কর্মসূচি শুরু হয়। বিকেল চারটার দিকে ইফতার বিতরণ করা হলেও দুপু্র থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে বৌদ্ধ মন্দিরের রান্নাঘর। যেখানে ইফতারির বিভিন্ন উপকরণ প্রস্তুত করা হয়।

প্রায় দুইশো মানুষের জন্য মন্দিরটিতে প্রতিদিন ইফতার তৈরী হয়। যা দরিদ্র মুসলমানদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।

সময়ের আগেই মন্দিরটির গেটে লাইন ধরেন নারী, পুরুষ ও শিশুরা। সুশৃঙ্খলভাবে লাইন ধরে তারা ইফতার গ্রহণ করেন। ইফতারে ছোলা, মুড়ি, বেগুনি, আলুরচপ, খেজুর, জিলাপি ও পেয়াজু দেওয়া হয়।

বৌদ্ধ মন্দিরে ইফতার নিতে আসা একজন নারী জানান, আমরা দুঃখ কষ্টের জন্য এখানে-ওখানে কাজকর্ম করি। তারপরও আমাদের ঘরে ঠিকমতো পয়সা আসে না।

আরেক নারী জানান, বাচ্চাদের খাওয়াই, নিজেরাও খাই। খাওয়ার পর উপকার হয়। সওয়াব হয়, আমাদেরও সওয়াব হচ্ছে।

জানা গেছে, এই ইফতারের প্রচলন করেন শুদ্ধানন্দ মহাথেরো। তাঁর প্রয়াণের পর বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ এই ধারা অব্যাহত রাখে। মূলত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দাতারা এর অর্থের জোগান দেন।

বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি বেদান্ত বুদ্ধপ্রিয় মহাথেরো বলেন, মানবতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখানে মুসলিম, হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আমরা বিবেচনা করি না। মানুষ হিসেবেই জানি। যারা দুস্থ, গরিব পবিত্র রমজান মাসে তাদের ইফতার দিই।

সবুজবাগে অবস্থিত বৌদ্ধ বিহারটি ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ২৮ জন আবাসিক বৌদ্ধ ভিক্ষু রয়েছেন। এছাড়াও ২৫০ জন এতিম শিশু বিহারটিতে থেকে পড়াশোনা করছেন। 

পাহাড়ের ওষুধ দোকানিরা মাথাব্যথায়ও দেন অ্যান্টিবায়োটিক

পাহাড়ের ওষুধ দোকানিরা মাথাব্যথায়ও দেন অ্যান্টিবায়োটিক

সামান্য মাথাব্যথার জন্যও অ্যান্টিবায়োটিক দেয় তিন পার্বত্য জেলার ওষুধের দোকানিরা। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল বিএমজে ওপেন–এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ ভাগ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন।

গবেষণা দলে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আদনান মান্নান, নাইম উদ্দিন হাসান চৌধুরী, তানভীর এহসান ও গবেষক কল্যাণ চাকমা; রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক গৌরব দেওয়ান; চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষক মাসুদ রানা; চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক এইচ এম হামিদুল্লাহ; এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের অধ্যাপক নাজমুল আলম ও অয়ন সাহা; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমজাদ হোসেন ও ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের জান্নাতুন উনাইজা।

২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত পার্বত্য এলাকা ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে চলতি বছরের ৮ মার্চ প্রবন্ধটি বিএমজে ওপেন–এ প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণায় জানানো হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, সাধারণ জ্বর, কাশি, সর্দি—এসব রোগের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছে পাহাড়ি লোকজন। এজিথ্রোমাইসিন ও এমোক্সিসিলিন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই জনগোষ্ঠীর ওপর অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতাও হারাবে।

গবেষণার জন্য রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ১ হাজার ৩৩৬ জন নারী ও পুরুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রতি দুজনের একজন অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছেন।

এমন যথেচ্ছ ব্যবহারের পেছনে চারটি কারণ বের হয়ে এসেছে। ১. দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের দূরত্বের কারণে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না যাওয়া, ২. চিকিৎসা খরচ নির্বাহে আর্থিক অসচ্ছলতা, ৩. নিকটস্থ ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কিংবা নিকট সম্পর্কের কারোর পরামর্শে কেনা এবং ৪. চিকিৎসকের পুরোনো ব্যবস্থাপত্র দেখে অ্যান্টিবায়োটিক কেনা।

গবেষক আদনান মান্নান বলেন, সমতলের তুলনায় পার্বত্য অঞ্চলে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের হার বেশি। এমনকি মাথাব্যথার জন্য প্রায় ১৪ ভাগ পাহাড়ি অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন। অথচ মাথাব্যথার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের প্রয়োজন পড়ে না। তাছাড়া ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাও দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।

গবেষকেরা বলছেন, পাহাড়িরা দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেছেন। অর্থাৎ বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করেছেন। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে নিজস্ব পদ্ধতি কাজ না–ও করতে পারে। এ ছাড়া এই অঞ্চলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘাটতি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও তদারকি বেশি প্রয়োজন। 

বিজু নিয়ে আলাপ করলেই লোগাংয়ের কথা মনে পড়ে

ইমতিয়াজ মাহমুদের লেখা

বিজু (বা বিঝু) উদযাপনে আমাদের সময় আড়ম্বর এতো হতো না। আমরা বাড়ী বাড়ী যেতাম, পাজন খেতাম। চৈত্র সংক্রান্তিতে সবজি একটা আমাদের ঘরেও হতো, অনুমান করি অনেক বাঙালীর ঘরেই হয়, কিন্তু রাঙামাটিতে চাকমা পাজন যেটা আমাদের ঘরের সবজিটা ঠিক সেটার মতো নয়। একশ রকমের উদ্ভিতজাত ফল, মুল, ফুল, লতা পাতা মিশিয়ে পাজন হয়। সবার ঘরে একরকম স্বাদ হয় না। উপাদান ভেদে বা রান্নার স্টাইলের কারণে একেক রকম স্বাদ হয় একেক ঘরে, কিন্তু সুস্বাদু হয় সবার ঘরেই। বছরের এই তারিখটা, এই দিনের আবহাওয়া এই সবকিছু মিলিয়ে পাজন আর আমাদের শরীরের মধ্যে যে সমীকরণ হয়, সেইটাই বৈশিষ্ট্য।

এখনকার মতো মেলা, কনসার্ট বা এইরকম অন্য কোন বিশেষ গণ-আয়োজন এগুলি হতো না। কারো কারো বাসায় পার্টির মতো হতো। আমাদের উদযাপন ছিল ঐ যে, সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে খাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, কিঞ্চিৎ পান করা এইসব। শুধু যে পাজন খেতে দিতো লোকে সেটা নয়, সাথে নানাপ্রকার সুস্বাদু খাবারও থাকতো। ভারি কোন খাবার সাধারণত পরিবেশন করা হতো না।কোন কোন বাড়ীতে ভাত হয়তো দিত সাথে, পোলাও কোরমা এইসব খাবার বিজুর সাথে যুক্ত ছিল না। পাজনের মধ্যে অনিবার্যভাবে কাঁঠাল তো থাকবেই, তীব্র স্বাদের মধ্যে কাঁচা আম থাকতো, আর করলা বা উচ্ছে এইসব। সব মিলিয়ে অমৃত।

আমি যখন রাঙামাটি কলেজ থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখনো পর্যন্ত আমার মনে একটা সিদ্ধান্ত ছিল যে যেখানেই থাকি বিজুতে অন্তত একদিন আমি যে কোন অবস্থাতেই রাঙামাটি থাকবো। পড়ে যখন বাপু বদলই হয়ে গেলেন রাঙামাটি থেকে কক্সবাজারে, পরিবাররে সবাই চলে গেলে কক্সবাজার তখন থেকে ধীরে ধীরে বিজুর সময় রাঙামাটি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিজু হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে আর আমদের পরিবারে আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। নিতান্ত অনিবার্য কোন কারণ না থাকলে পহেলা বৈশাখ পুরো পরিবারের সাথে উদযাপন করতে হয়। আমার মা থাকতেও এটা ছিল, এখনো এই নিয়ম বিদ্যমান আছে।

২.

এখন তো আমার নিজেরই একটা পরিবার হয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রী আর দুই কন্যার সাথে এই অধমকে মিলিয়ে। আমরা উৎসব হিসাবে দুই ঈদ, পহেলা বৈশাখ, ক্রিসমাস, ইংরেজি নববর্ষ, দুর্গা পূজা এই সবই উদযাপন করি। এই সবকিছুর মধ্যে পহেলা বৈশাখটা হচ্ছে প্রধান। দুই ঈদের বা অন্য কোন পালা পার্বণের চেয়ে পহেলা বৈশাখটা আমাদের কাছে উদযাপনের হিসাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পহেলা বৈশাখের সুবিধা হচ্ছে যে এর সাথে কোন ধর্মীয় আচার আচরণ জড়িত নাই, আপনি আপনার ইচ্ছামতো যেভাবে চান সেভাবেই উৎসব বা উদযাপন সাজাতে পারেন। আমরা চেষ্টা করি সব ভাইবোন ওদের বাচ্চা কাচ্চা সবাই অন্তত এক বেলা একসাথে হতে।

পহেলা বৈশাখ যদি আপনি ঢাকায় উদযাপন করতে চান তাইলে তো বিজুর সময় আর রাঙামাটি যেতে পারবেন না। এই কারণে আমার আর বিজুতে রাঙামাটি যাওয়া হয়না। জেনেছি যে এখন নাকি রাঙামাটিতে বিজু উপলক্ষে অনেক আয়োজন হয়। অনেক মেলা হয়, দোকানপাট বেসে, কনসার্ট হয়, গান বাজনা নাচের অনুষ্ঠান হয়। আমি যদি রাঙামাটি থাকতাম তাইলে সম্ভবত বিজু উপলক্ষে ছোট একটা সাহিত্য সংকলন করতে চেষ্টা করতাম। কেউ কেউ নিশ্চয় সেটা করেন, আমারই হয়তো জানা নেই। বেশী অনুষ্ঠান হতে থাকলে অনেক সময় উৎসবের মুল সুরটা ম্লান হয়ে যায়- বিজু উপলক্ষে রাঙায় এরকম হয় কিনা জানিনা।

সমানে বিজু, রাঙামাটিতে এখন নিশ্চয়ই ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ী সবাই বিজুর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। উদযাপনের ধরন পাল্টেছে, উৎসবের ব্যাপ্তিও বেড়েছে নিশ্চয়ই। তথাপি মুল সুরটা কখনো পাল্টায় না। চৈত্রের দাবদাহ, বছরের শেষ দিন, পাহাড়ে প্রকৃতির রূপ রঙ পরিবর্তনের সূচনা এই সব মিলিয়ে চাকমা সমাজের এই উৎসবের দিনে চাকমা তরুণ তরুণীরা নিজেদের উৎসের দিকে ফিরে তাকাবেন, আত্ম পরিচয়, জাতিগত অধিকার, বৈষম্য বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই এই সবকিছুই নিশ্চয়ই তরুণদের উৎসব উদযাপনের অনুষঙ্গ হয়ে আছে এখনো। নিজের দিকে ফিরেও তাকাবো এবং নিজের পরিচয়েই আনন্দ করবো।

৩.  

আনন্দ তো করবই, আনন্দই মুল, কিন্তু যে আনন্দ আমার সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে ধারণ করে না সেটা বড়ই নিম্নমানের স্থূল আনন্দ। রাঙাতে তরুণ বন্ধুরা যারা আছেন, আমি জানি এই বিজুতে আপনাদের উদযাপনের সুরেও বিশ্বব্যাপী আদিবাসী মানুষের যে চলমান সংগ্রাম বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সেই সূরও এসে মিশে যাবে। গেংখুলির সুরে দেখবেন একটা প্রলম্বিত উদাসীন সুর অন্তর্ভুক্ত থাকে- সেই সুরটা হচ্ছে পাহাড়ের মানুষের জীবনের আনন্দের সাথে উচ্ছ্বাসের সাথে কান্নার সংযোগ। সেই কন্নাটা, সেটা মনে রাখবেন। 

বিজু নিয়ে আলাপ করলেই লোগাংএর কথা মনে পড়ে। কেননা আমার দেখা মতে সেই একবারই বিজু উৎসব বর্জনের কথা হয়েছিল- সেবারের বিজু ছিল কান্নার বিজু, ক্রোধ ও বেদনার বিজু। আপনি যখন এইবার বিজুতে আনন্দ করবেন, আনন্দ নিশ্চয়ই করবেন- সেটা জীবনেরই অংশ, সারা দিনের আনন্দের এক ফাঁকে অন্তত একটা মিনিটের জন্যে হলেও লোগাং এর কথা স্মরণ করবেন। ভুলবেন না।

সকলেই ভাল থাকুন। আনন্দ হোক।  


লেখক: ইমতিয়াজ মাহমুদ, প্রগতিশীল লেখক ও আইনজীবী। *লেখাটি ফেইসবুক থেকে নেওয়া। 

পাওয়ার হিটিংয়ে টাইগারদের দুর্বলতা, পাহাড়ি ক্রিকেটার চায় বিসিবি

পাহাড়ি ক্রিকেটার চায় বিসিবি

দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উঠে আসা অ্যাথলেট কিংবা খেলোয়াড়েরা ফুটবল, রেসলিং, হ্যান্ডবল, কাবাডিতে বেশ নাম করলেও ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। পাহাড়ি দুর্গম এলাকা থেকে উঠে আসা ক্রিকেটার নেই বললেই চলে। তবে এবার ক্রিকেটেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের আগ্রহী করতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।

পাহাড়ে বসবাসরত মানুষদের ক্রিকেটের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে রাঙামাটিতে ভেন্যু সংস্কার ও আগামী বছর থেকে ন্যাশনাল ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনা করছে বিসিবি। এজন্য অতি সম্প্রতি সেখানে পর্যবেক্ষণে গেছেন বিসিবির টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি।

বিষয়টি নিয়ে ববি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘রাঙামাটিতে আগে থেকেই স্টেডিয়াম ছিল। কিন্তু চিন্তাভাবনা করছি সেখানে আগামী বছর একটা ভেন্যু করব ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য। এখানে পাহাড়ি যে জনগোষ্ঠী আছে, তাদের ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা খুব কম। ফুটবলে কিন্তু অনেক আছে। ক্রিকেটে কিন্তু সে রকম নেই। একটা জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এ চিন্তা-ভাবনা। সেখানে খেলা হলে অনেকে আগ্রহী হবে, পরে আমরা বিভিন্ন ধাপে যেতে পারব।’

ক্রিকেটে পাহাড়িদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে দেশের প্রথমসারির একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পাওয়ার হিটিংয়ে টাইগার ব্যাটাররা বেশ পিছিয়ে রয়েছেন। ভবিষৎতে দুর্বলতা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে নতুন পরিকল্পনা।

বিসিবির টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আহমেদ সাজ্জাদুল আলম জানান, পাহাড়ি অঞ্চলে যারা বড় হয়ে উঠেন তাদের একটা কঠোর দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেইখান থেকে তারা শারীরিকভাবে এগিয়ে থাকে। তাছাড়া আদিবাসীরা এ দেশের সন্তান, তারা এ দেশের নাগরিক; তাদের আমাদের সম্পৃক্ততা করাটা মনে করি জাতীয় দায়িত্ব। 

যৌথবাহিনীর কম্বিং অপারেশন শুরু, কেএনএফ’র শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার

যৌথবাহিনীর কম্বিং অপারেশন

বান্দরবানের থানচি ও রুমায় ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ ও অস্ত্র লুটের পর কম্বিং অপারেশন শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। রোববার (৭ এপ্রিল) দুপুরে বান্দরবান ৬৯ সেনা রিজিয়ন মাঠে গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

সেনাপ্রধান বলেন, ইতোমধ্যে কম্বিং অপারেশন শুরু হয়েছে। বিভিন্ন বাহিনী সম্মিলিতভাবে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অভিযানের সফলতার জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনে সব বিষয় আমরা প্রকাশ না করলেও জনসাধারণের যেটুকু জানা প্রয়োজন আমরা তা গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করব।

অপারেশনে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়ক চেওসিম বমকে (৫৫) গ্রেফতার করার তথ্য জানায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। আজ বিকালে বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের শ্যারনপাড়ার বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

এসময় তার বাড়ি থেকে জীবজন্তু মারার বন্দুক (এয়ারগান) উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ জানিয়েছেন, নাথান বমের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে চেওসিম বমের। শ্যারনপাড়ার বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, ২০১৪-১৫ এর দিকে ছয়টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কেএনডিও নামে স্যোশাল অর্গানাইজেশন গঠন করা হয়। চেওসিম বম প্রথম দিকে কেএনডিও-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। চেওসিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা অন্যদের অবস্থান ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি।

তবে চেওসিম বম কেএনএফ-এর সদস্য নয় বলে ফেইসবুক পেজে দাবি করেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট - কেএনএফ। 

আইডেন্টিটি ক্রাইসিস অফ গারো পিপলস

গারোদের পরিচয় বিতর্ক
                                                                  

সভ্যতার যে ক্রমর্বধমান ইতিহাস সেই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে পৃথিবীর বহু জনগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীর নিজস্বতা বিলুপ্ত হয়েছে। পৃথিবীর যে ধারায় এই একবিংশ শতাব্দীতে চলমান রয়েছে যেখানে পুঁজির বিকাশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ভাষাগত আগ্রাসনের দৌড়াত্ম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এতে করে জনসংখ্যায় তুলনামূলক কম জনগোষ্ঠীগুলোর টিকে থাকা মুশকিলে হয়ে পড়েছে।

ভৌগলিক অবস্থার বিচারে এবং বাংলাদেশের জাতিগত ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে বাংলাদেশে বহুজাতিসত্তার বিকাশ একটা দীর্ঘ সময় ধরে হয়েছে। কিন্তু জাতিরাষ্ট্রের তথাকথিত যে বিকাশ সেই বিকাশে এই জনগোষ্ঠী গুলোর বিকাশ তো দূর বরং সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক শোষণ এবং নিপীড়নে নিজের অস্তিত্ব ভুলতে শুরু করেছে বহু জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে বসবাসরত যে সকল জনগোষ্ঠীগুলো নিজেদের সঠিক অস্তিত্ব ভুলতে বসেছে তাদের মধ্যে একটি জনগোষ্ঠী হলো গারো জনগোষ্ঠী। যারা নিজেদের ভাষায় নিজেদের মান্দি বলে পরিচয় দিতে এক সময় পছন্দ করতো। আমরা যদি আলোচনার মূল বিষয়ের দিকে নজর দেই তাহলে সব থেকে জরুরি যে সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে সেইটি হলো, এই জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের অবস্থানগত জায়গায়।

জাতিগত পরিচয়কে অক্ষত রাখার প্রথম ধাপ হিসেবে দাঁড়ায় অনেকাংশে নিজের সংস্কৃতির চলমান ধারাকে মুক্তভাবে বইতে দেওয়া। কিন্তু একটি রাষ্ট্র যখন জাতিরাষ্ট্রের ধারণাকে লালন করার মধ্যদিয়ে অন্য জাতির অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে তখন সেই জাতিগুলোর জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ কতটা বহমান থাকবে এবং নিজেদের আত্মপরিচয় কতটা সমুন্নত রাখতে পারবে সেইটা আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সব থেকে বড় যে সমস্যা পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো জাতিগত সমস্যা। বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরে যে সকল ভিন্ন ভিন্ন জাতিগুলো রয়েছে তাদের জাতিগত পরিচয় রাষ্ট্র কিভাবে নির্ধারণ করবে এবং এই নির্ধারনের দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের কিনা। বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে এই জনগোষ্ঠীগুলোকে  জাতিগত পরিচয় দিতে নারাজ। রাষ্ট্র নানা সময়ে নানান নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যেখানে দেখতে পাবেন ট্রাইবাল, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, জুম্ম, শরনার্থীর মত প্রায় ১৬টি নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতিসত্তা জাতিগত পরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেছে যার ফলে এই সকল জনগোষ্ঠীগুলোর জাতিগত পরিচয় আজ নানাভাবে সংকটে।

রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট জাতিগত পরিচয় নিয়ে যে টানাপোড়ন তৈরি হয়েছে এর মাঝে নতুন করে গারো জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় কি হবে সেই বিষয় নিয়ে র্দীঘদিন ধরে একটা রেশ টানার প্রক্রিয়া তৈরি হয় বিভিন্ন মিশনারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আগমনে। যদিও এই আলোচনার খাতিরে এই জাতিগত পরিচয় সংক্রান্ত সমস্যায় মিশনারীদের অবস্থান নতুন বলা হলেও এর যে প্রক্রিয়া তা শুরু হয়েছে গারো জনগোষ্ঠীগুলোর মাঝে ধর্মীয় বিস্তারের মধ্য দিয়ে। একটি জনগোষ্ঠীর বিকাশের  ধারায় সংস্কৃতিগত পরিচয় অত্যন্ত জরুরি এবং অর্থ বহন করে। সংস্কৃতিকে বৃহৎ অর্থে ব্যাখা বা বিশ্লেষণ করলে যা দেখা যাবে তা অনেকাংশে এমন শুধুমাত্র ধর্মকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতির বিকাশ হয় না। বরং সংস্কৃতির অন্যান্য কাঠামোকে কেন্দ্র করে সেক্টরকে কেন্দ্র করে ধর্মের বিকাশের একটি জায়গা থাকে। বা বলা যায় অনান্য সেক্টর বা কাঠেমোর মত সমান্তরালভাবে সংস্কৃতিতে ধর্মের বিকাশ পরিলক্ষিত হবে। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশে বসবাসরত গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশনারীদের বিকাশ বা উত্থানের ইতিহাস দেখতে যাই তাহলে একটু চোখ রাখতে হবে সাধু যোসেফ ধর্মপল্লী রানীখং এর দিকে। ইতিহাস বলছে বাংলাদেশে গারো অঞ্চলগুলোতে মিশনারীদের বিকাশের যে ধারা তার শুরু হয় অনেকটা এই ধর্মপল্লীর হাত ধরে ১৯০৯ থেকে ১৯০১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। রোমান ক্যাথলিকদের এই বিকাশের আগেও ১৮৯০ শতকের দিকে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীর বিকাশ যা এখন গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন নামে পরিচিত। সুসং দুর্গাপুর অঞ্চলে গারোদের মাঝে ধর্ম বিস্তার করতে গিয়ে এই দুই মিশনারীর মধ্যে মত পার্থ্যকের  বিরোধ দেখা যায়। যার ফলে আলাদা আলাদা স্কুল কলেজ বিভিন্ন হোস্টেল এবং মিশন কেন্দ্রীক ভিন্ন ভিন্ন  প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। যার ফলে গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে ধর্মীয় পরিচয়ের যে সমস্যা তার সূত্রপাতের সময়কাল আমরা ওই সময়কেই ধরতে পারি।  মোটা দাগে মিশনারীদের আগমনে গারোদের জাতিগত যে ধর্মের পরিচয় নিয়ে দ্বন্ধের সূত্রপাত বললেও পুরো লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব।

শুধু গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে মিশনারীদের বিকাশ না দেখে পুরো বিশ্বজুড়ে যে প্রক্রিয়ায় মিশনারীর বিকাশ হয়ছে সেদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মিশনারীদের বিকাশ হয়েছে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। যে অঞ্চল এবং যে জনগোষ্ঠীর মাঝে মিশনারীরা প্রথম এসেছে তাদের কাছে সরাসরি ধর্মের কথা নিয়ে আসেনি বরং প্রথমে স্থাপন করা হয়েছে চিকিৎসালয় এবং সেই জনগোষ্ঠীর মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে প্রকৃতিকেন্দ্রীক রোগমুক্তির যে ধ্যান ধারনা তা মিথ্যা এবং ভুল। ঠিক একইভাবে মিশনারীর আওতায় বিভিন্ন স্কুল স্থাপন করা হয়েছে জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব সামাজিক শিক্ষা কাঠামোর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা এবং প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশ হলেও নিজস্ব সামাজিক শিক্ষা কাঠামোর বিকাশ দেখা যায়নি।

আলোচনার বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়া এই জনগোষ্ঠীগুলোর আইডেন্টিটিতে কি প্রভাব তৈরি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে কাপ্রু ম্রো পাড়ায় ম্রোদের আদিধর্ম ক্রামায় বিশ্বাস করে এমন পরিবারের সংখ্যা দেখা মিলবে ৪টি থেকে ৫টি; যেখানে সদ্য বিস্তার লাভ করা খ্রিস্টীয় চার্চভূক্ত ম্রো পরিবারের সংখ্যা ৪০টির মতো। দুটো ধর্মের বিশ্বাসীরা রবিবারে নিজস্ব উপাসনালয়ে যাচ্ছে এবং যাওয়ার পথে উপসানালয়কে নির্দিষ্ট করে বলতে গিয়ে বলতে হচ্ছে ক্রামা কিঙং খ্রিস্টার কিঙং। একই সংস্কৃতিভূক্ত একই পাড়াভূক্ত একই জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয় হয়ে যাচ্ছে ভিন্ন। ঠিক একই বিষয় দেখা মিলবে বান্দরবানের ত্রিপুরা এবং খাগড়াছড়ির ত্রিপুরার মধ্যে। যেখানে সনাতন ধর্মের বিকাশের সাথে সাথে মিশনারীদের বিকাশ হয়েছে এবং নির্দিষ্ট পরিচয়ের জায়গা থেকে সরে এসেছে।

কিন্তু গারো জনগোষ্ঠীর প্রায় অনেকাংশে দেখা যায় মিশনারী চার্চভূক্ত। মধুপুর বন অঞ্চল ছাড়া কোথাও আদি ধর্ম সাংসারেক বিশ্বাসীদের দেখা যায় না। যার ফলে গারোদের যে বনকেন্দ্রীক বিভিন্ন মিথ রয়েছে তার চর্চা দেখা যায় না। অথচ গারোদের সংস্কৃতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বনকেন্দ্রীক মিথ।

মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে অবস্থিত বালপাকরাম নিয়ে মিথ

বালপাকরাম মানে আত্মার ভূমি। যেখানে গারোদের পূর্বপুরুষদের যে আত্মা সেই আত্মা মৃত্যুর পর এই পাহাড়ের গিরিপথে অবস্থান করে। বালপাকরামে আত্মার অবস্থান খুব বেশি সময়ের জন্য না, বালপাকরাম পাহাড়ের চূড়ায় যে শস্য ফলে সেই শস্য খেয়ে অন্তিম যাত্রা পথে একটু জিরিয়ে নেয় মৃত আত্মা। পূর্বপুরুষদের আত্মার আশীর্বাদেমি মিসি’, মানে জুমের ধান আরো ভালো ফলন হবে; তাই বালপাকরামের চূড়ায় ফসল রেখে দেওয়া হয় এইসব আত্মার জন্য। এতে বালপাকরাম পাহাড় ফসলে স্বয়ং সর্ম্পূণ থাকতো। যার ফলে বালপাকরাম পাহাড়ের অন্যান্য প্রাণীদের কখনো খাদ্যের অভাব হয়নি। বালপাকরামকে কেন্দ্র করে যে গারো গ্রামগুলো রয়েছে সেখানে বাস করা গারোরা মনে করে এই বালপাকরাম ছেড়ে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই কারণ এই বালপাকরামে রয়েছে পূর্বপুরুষদের আত্মার অবস্থান স্থল এবং নিজেদের মাহারি বা আত্মীয় স্বজনদের সাথে মৃত্যুর পর শেষবার মিলিত হওয়ার সুযোগ। বনকেন্দ্রীক এই মিথ গুলোর মধ্য দিয়ে হাজার বছর বনকে আকরে বাঁচার প্রক্রিয়া তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গারোরা বছরের পর বছর ধরে নিজেদের সংস্কূতির বিকাশ করেছে। 

চিৎমাং পাহাড়ের চূড়া নিয়ে গারোদের মিথ

চিৎমাং পাহাড়ের চূড়া হলো গারোদের অন্তিম আত্মার শেষ স্থল। যেখানে বালপাকরামের পর এই পাহাড়ের চূড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আত্মারা। চিৎমাং এর দায়িত্বে থাকেন একজন রাজা যার নাম ওয়াইমং। তিনি হলেন গারোদের সকল দেবতার গুরু। মৃত্যুর পর তিনি সকল আত্মার বিচার করবেন এবং পাপের উপর নির্ভর করে পৃথিবীতে আবার পাঠাবেন। গারোদের পাপ পূণ্য নিধারণ হবে প্রকূতিকে কে কতটা লালন করতে পেরেছে তার উপর।

বনের ভিতর ঘর তৈরি নিয়ে গারোদের মিথ

গারোদের মিথ জুড়ে স্বপ্নের একটা বিশাল ভূমিকা বা জায়গা রয়েছে। গারোরা মনে করে বন বা জমি মাটি তার শক্তি মানুষের সাথে ভাগ করে। যার জন্য নতুন বাড়ি তৈরির আগে গারোরা যখন নতুন কোনো জায়গা ঠিক করে তখন সেই জায়গার বন বা মাটিকে তাদের শক্তিকে আগে গারোদের হাতে হস্তান্তর করবে। এবং জায়গা নির্দিষ্ট করার পর আগে এই শক্তির কাছে পূজার মধ্য দিয়ে জানতে চাওয়া হয় এই জায়গা বাড়ির জন্য উপযুক্ত কিনা। পুরো ব্যাপারটা হয়ে থাকে স্বপ্নের মাধ্যমে।

বন্য পশু নিয়ে গারোদের মিথ

জাংগ্গিনি নকগিপ্পা জামানি বিয়াম্বি মানে জীবন নিঃশ্বাসের উৎস যিনি তিনি পৃথিবীর কোনো প্রাণীকে ভক্ষণ করার জন্য সৃষ্টি করেননি। প্রাণী জগতের সকল প্রাণীকে সম্মান করার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়ে বলেন যদি কেউ বন্য প্রাণীকে ক্ষতি না করে তাহলে দেবতা খালখামে-খালাগ্রা সকল প্রকার বন্য প্রাণীর হাত থেকে গারোদের রক্ষা করবে।

গারোদের আদিধর্ম সাংসারেকদের হাবাহুয়া বা জুম চাষের শুরু হয়মিসি সালজংকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে। যেখানে মিসি সালজং হলো গারোদের সকল প্রকার ফল ফসলের সম্পদের দানকারী দেবতা। সাংসারেকরা নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় যে ওয়ানগালা উৎসব পালন করে তা এই দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে। প্রকৃতিকেন্দ্রীক বন, পাহাড়কেন্দ্রীক ধ্যান-ধারনা বাঁচার সংগ্রাম গারোদের আজকের না বহু বছর ধরে লালন পালন করে আসছে। যার ফলে বালপাকরাম গিরি রক্ষা, বন রক্ষা, গাছ রক্ষার মত বিষয় গারোদের সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারনে চলে আসছে দীর্ঘ বছরের মধ্য দিয়ে।

প্রকৃতিবাদী এই সাংসারেক ধর্মের অন্যান্য দেবদেবীর নাম এবং উপাস্যের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করলে দেখা মিলবে প্রকৃতির সাথে এই জনগোষ্ঠীর কতটা মিলন।

সাংসারেকদের বিভিন্ন দেব-দেবীর নাম

তাতারা রাবুগা - পৃথিবীর সকল প্রকার প্রাণীর প্রাণের সৃষ্টিকর্তা। নস্তু-নপান্তু যাকে বলা হয় সকল প্রকার প্রাণীর সৃষ্টি কাজে সাহায্যকারী দেবতা। বিশাল প্রাণের সূষ্টিতে তাতারা রাবুগাকে সাহায্যকারী দেবতা। মাচ্চি নস্তু-নপান্তুর স্ত্রী বা সৃষ্টি কাজে সাহায্যকারী দেবী।

মিসি সালজং বা সালগ্রা - সাংসারেকদেক সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেবতাদের একজন। যিনি সকল প্রকার ফল ফসলের সম্পদের দানকারী দেবতা। সুসিমেমা দেবী গৃহের খাদ্য শস্য মজুদের রক্ষাকারী দেবী। রুক্ষীমেমা আহারের জন্য প্রস্তুত খাদ্যের রক্ষাকারী দেবী। কেউ কেউ শূচি বায়ূ দেবীও বলে। চুরা বুদি ক্ষেতের ফসল রক্ষাকারী দয়ালু দেবতা। গয়রা বা গোয়েরা - বজ্র বিৎদ্যুতের দেবতা। মানুষের অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতা খালখামে-খালাগ্রা দেবতা গয়রার ছোট ভাই। আচিক মান্দিদের বন্যপশুর আক্রমণ থেকে রক্ষাকারী দেবতা। আকস্মিক দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতা।

নকনি মিদ্দে-রংদিক মিদ্দে - চাউল যে পাত্রে সংরক্ষণ করে। মিসি সালজং বা সালগ্রা, সুসিমেমা রুক্ষীমেমা দেবতাদের অনুগ্রহ আশীর্বাদ ছাড়া মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব। তাই একে তিন দেবতার হাত বলে। সুসুমি দেবী- বিদ্যা, বুদ্ধি কূটনীতির ধারক বাহক। আচ্চু আম্বীদের মুখে শোনা এই সুসুমি দেবী, অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব, বোবা, কালা প্রভৃতি জরা ব্যাধির কারণ। পৌরাণিক কাহিনীতে পৃথিবী সৃষ্টির জন্য তাতারা রাবুগা এই দেবী সুসুমির পরামর্শ গ্রহণ করেন। পৃথিবী সৃষ্টির পর নিজেদের সাদৃশ্যে মানুষ সৃষ্টির জন্যও এই দেবীর পরামর্শক্রমে সকল দেবতাদের কাছে ডাকেন সৃষ্টিকর্তা তাতারা রাবুগা। পরে মানুষ সৃষ্টির পর পৃথিবীতে মানুষের বাস উপযোগী স্থান নির্ধারণের জন্য দেবী সুসুমিকেই এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। আচিক মান্দিদের সব ধরণের বিদ্যা শিক্ষা দিবার জন্যও এই দেবী সুসুমিকেই আবার পৃথিবীতৈ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

নাওয়াং : মৃত ব্যক্তিদের আত্মাদের পরপারের রাস্তার পাহারাদার। কথিত আছে, মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা নাওয়াংকে পয়সা, টাকা না দিলে রাস্তা পার হওয়া যায় না। তাই আচিক মান্দিরা মৃত ব্যক্তির হাতে টাকা গুজে দেয়। আসিমা-দিংসিমা : সুসুমি দেবীর মা। পৃথিবীর শান্তি রক্ষাকারী দেবী। কোন প্রকার প্রাণীর বলি সে পছন্দ করে না। তার জন্য কোন ফল উৎসর্গ করলেই সে পরিবারে, গ্রামে শান্তি প্রদান করে। টংরেংমা : ব্যক্তিকে সাহস দানকারী গৃহে শান্তি রক্ষাকারী দেবী। আল্লেমী - সব দেবীদের রাণী। মেগাপাফিয়া - শিশুদের সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষাকারী দেবী। চু রাশি - শিশুদের অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতা। আন্নিং - শিশুদের মাতৃগর্ভ থেকে বোবা, কালা, অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষাকারী দেবী। চাগব - শিশুদের শয়তানের কু নজর থেকে রক্ষাকারী দেবতা। চি গিচ্ছাক - বাত রোগের আরোগ্যকারী দেবতা। ওয়াল গাথ - যুদ্ধে আঘাতের ব্যথার আরোগ্যকারী দেবতা  জগু - ফুসফুসের পীড়ার আরোগ্যকারী দেবতা। সাল বামন - মাথা ব্যথা চোখের পীড়ার আরোগ্যকারী দেবতা। উদুম মিদ্দে - পেটের পীড়ার আরোগ্যকারী দেবতা। নচীডু-মারুচাং - পাতাল পুরীর রাজা দেবতা। ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস থেকে মানুষকে রক্ষাকারী। চিরিং চিমিট - পাতাল রাজার স্ত্রী দেবী। পাহাড়ের ঝর্ণার জল দানকারী দেবী।রমনজার - জীবন্ত ছোট পাথর। মানুষ সৃষ্টির জন্য অন্য গ্রহের মাটি পিঠে বহণ করে আনাতে সেও পাথর হয়ে যায়। ডিনজার - জীবন্ত ছোট পাথর। মানুষ সৃষ্টির জন্য অন্য গ্রহের মাটি পিঠে বহণ করে আনাতে সেও পাথর হয়ে যায়। নরে চিরে, কিমরে বকরে : বৃষ্টির দেবী। বোন জাসকো - অরণ্য দেবতা। বনের সমুদয় প্রাণীর রক্ষাকারী দেবতা। গান্দো - অরণ্য দেবী। বোন জাসকের স্ত্রী। দারিচিক মিদ্দে - মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ তৈরিকারী স্ত্রী লোকের যৌন রোগের আরোগ্যকারী দেবী। রুরুবে খিন্নাসে - মানুষের নারী ভুরী, ফুসফুস, যকৃৎ, কিডনী তৈরিকারী এইসব রোগের আরোগ্যকারী দেবী। জারুমে আজাবাল : বায়ু দেবতা। মিকখা টেম্মা স্টিল রংমা - ঘূর্ণি ঝড়ের দেবতা। মিসি আপিলফা - মাটির উর্বরতার দেবতা। সালজং গালাফা - ধান ক্ষেতের পাহারাদারের রক্ষক। দিম্মেং কককেং - নব দম্পতিদের আশীর্বাদ দানকারী। দিম্মেং - আদম কককেং - হবা। তোয়ারা নাংগাপা - মুর্ছা যাওয়া থেকে রক্ষাকারী। বিদাউই মিদ্দে - সূতিকা রোগের আরোগ্যকারী দেবী।

বাংলাদেশে মিশনারীদের আগমনের পরবর্তী সময়ে গারোদের হাজার বছর ধরে লালিত প্রকূতিকেন্দ্রীক যে বিশ্বাস সেই বিশ্বাস থেকে সরে এসে চার্চকে কেন্দ্র করে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এই আগ্রহ তৈরির সাথে সাথে নিজস্ব চিন্তার জায়গা থেকে শুরু করে নিজস্ব খাদ্যাভাস থেকেও অনেক দূরে অবস্থান করছে গারো জনগোষ্ঠী। বনকে কেন্দ্র করে খাদ্য সংগ্রহের যে ধারনা, বনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার যে তাগিদ, সেই তাগিদ সাংসারেক বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে বিলীনের পথে। আব্রাহামিক ধর্মের চর্চায় সকল সৃষ্টির মালিক স্রষ্টা এবং স্রষ্টাই শেষ কথা। যার ফলে সৃষ্টির অন্যান্য প্রাণের সম্ভারকে বাইপাস করে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়ার যে প্রক্রিয়া তা চলমান রয়েছে। একেশ্বরবাদী ধ্যান ধারণায় গারোদের বন পাহাড় কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া দেব-দেবীর ধারণা খারিজ হয় এবং ইতিহাসের পাতায় স্থান হয় বিভিন্ন প্রেতাত্মার নামে। 

গারোদের নিজস্ব গান্দাবারা রীতি ভেঙে পুঁজির সাথে পরিচয়

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক রীতি চালু আছে যেখানে দেখা যায় সাময়িকভাবে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার কৃষি কাজের জন্য অকুলান হয়, তখন একজন ব্যক্তি বা এক পরিবারের শ্রম ধার দেওয়া হয়। বৃদ্ধ বা অক্ষম লোক রয়েছে এমন পরিবারকে সামর্থ্যবান বয়স্ক নর-নারী তাদের একদিনের শ্রম দান করে। রোগী, গর্ভবতী স্ত্রীলোক এবং সন্তান প্রসবের পর নতুন মাকে খাদ্য প্রদান করে। এই রীতিকেমালেইয়ারীতি বলা যায়। যা মূলত জুম চাষের উপর নির্ভর সমাজ বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়।  

একই ধারার প্রচলন গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত; যাকে বলা হয়গান্দাবারা এই গান্দাবারা রীতিতে পুরো গ্রামের লোক এক এক করে সবার জমির ফসল কেটে দেওয়ার কাজ করে বিনা পারিশ্রমিকে। যে বাড়ির ফসল কাটা হয় সেই বাড়িতে কাজ শেষে সন্ধ্যাবেলায় সবাই মিলে আহার গ্রহণ করে। কিন্তু সাংসারেক ধর্মের বিলুপ্তি এবং আব্রাহামিক ধর্মের বিকাশ বা মিশনারীদের উত্থানের ফলে মার্ক্সীয় তত্ত্ব মতে পুঁজির বিকাশ এবং পুঁজির বিকাশের সাথে সাথে শ্রম মজুরির অসম বন্টন সূত্রপাত হয় এই জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে।

মিশনারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য বৃহৎ পুঁজির সাথে এই জনগোষ্ঠীর পরিচয় এবং দানবাক্স নামক তত্ত্বের উদ্ভব আস্তে আস্তে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব অর্থনৈতিক বা বিনিময় কাঠামোকে ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করে। ধর্মীয় ধ্যানকে সামনে রেখে শ্রম এবং মজুরির অসম বিকাশ পুরো কাঠামোকে ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করে।

বিশুদ্ধতার প্রশ্নে সাংসারেক

সাংসারেক কামালদের কাছে লোকগল্প আকারে শোনা যায় এক দম্পতি যারা মধুপুরের বনকে কেন্দ্র করে বাস এবং সাংসারেক ধর্মে বিশ্বাস করতো। কিন্তু দম্পতির স্ত্রী খ্রিস্টান হয়ে যাওয়ার পর সংসার ত্যাগ করে নিরুদেশ গমন করেন। জাতির বিশুদ্ধতা, সংস্কৃতির বিশুদ্ধতায় আন্তঃধর্মীয় বিবাহ বা আন্তঃসংস্কৃতি মিশ্রনের একটি ভয় চেপে ধরতে শুরু করে গারো জনগোষ্ঠীকে।

গারো জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের নিজস্ব জাতির বিশুদ্ধতা রক্ষার রক্ষনশীল প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন দেখা যায় সাংসারেক বিলুপ্তির পর। গারো জনগোষ্ঠীর বাইরে সাংসারেক বিশ্বাস যেমন অন্য জনগোষ্ঠীরা করে না. তেমনি অন্যান্য জাতিসত্তা যাদের পুরো সংস্কৃতি কাঠামো গারো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কাঠামোর বিপরীতে তাদের সাথে একীভূত হওয়া এবং হয়ে শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা তৈরি হয় ধর্মীয় পরিচয়কে কেন্দ্র করে। যার ফলে পিউর ব্লাড বলে যে থিউরি এক সময় প্রচলন ছিলো তার পরিবর্তন হয়। নিজেকে গারো বলে পরিচয় দেওয়ার বাইরে নিজেকে খ্রিষ্টিয়ান বলে পরিচয় দেওয়ার প্রবল আর্কষণ বৃদ্ধি পায়। মিশনারীদের আগ্রাসনমুখী ধর্মের বিকাশের সাথে একই ধর্মেরভূক্ত করার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে জাতিগত পরিচয়ের উর্ধ্বে নেওয়ার পূথিবীব্যাপী  চেষ্টায় গারো জনগোষ্ঠী সামিল হয়। এবং পুরা প্রক্রিয়া গারো জনগোষ্ঠীকে যেভাবে চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে এতে রাষ্ট্র কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়ার বিভিন্ন নামে বেনামে পরিচয় এবং একই সাথে নিজস্ব ধ্যান ধারণা চিন্তার বাইরে ধর্মীয় পরিচয় পুরো জনগোষ্ঠীর আইডেন্টিটির মাঝে তৈরি করেছে সংকট। গারোরা আসলেও গারো নাকি উপজাতি নাকি খ্রিস্টিয়ান।

লেখক: প্রত্যয় নাফাক, সাবেক সভাপতি ছাত্র ইউনিয়ন, চবি সংসদ। 

© all rights reserved - Janajatir Kantho