আদিবাসীদের উপর হামলা নিয়ে সরকারের বিবৃতি যথেষ্ট নয়: টিআইবি

 


ঢাকার মতিঝিলে আদিবাসী ছাত্র-জনতার উপর হামলা নিয়ে সরকার যে বিবৃতি দিয়েছে, তা সময়োপযোগী হলেও যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সরকারের বিবৃতিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় না দেওয়ায় ক্ষোভও জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।

শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি), এক বিবৃতিতে ক্ষোভ জানায় টিআইবি।

নবম দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে পেছনের প্রচ্ছদ থেকেআদিবাসীশব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দিয়ে এনসিটিবি নিজেকে পতিত কর্তৃত্ববাদের দোসর পুনর্বাসনকেন্দ্র হিসেবে পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করে সংগঠনটি।

বিবৃতিতে সরকারের উদ্দেশে টিআইবি বলেছে, জাতীয় আর্ন্তজাতিক সমালোচনাকে মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীকে বলতে চেয়েছিলবাংলাদেশে আদিবাসী নেই। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্বীকার করতে চায়নি যে, আদিবাসী পরিচয়ের মানদণ্ড কোনো জনগোষ্ঠী কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে কতকাল ধরে বসবাস করছেনতার ওপর নির্ভর করে না। তারা মানতে চায়নি যে, আদিবাসী হচ্ছেন মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে এমন জনগোষ্ঠী, যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং প্রথাগত প্রাকৃতিক পরিবেশ-নির্ভর জীবনাচরণের ধারা বহাল রেখে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচিত থাকতে চায়।

দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনটি মনে করে, আদিবাসী পরিচয়ের এই ব্যাখ্যা যে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত, তা না জানা এনসিটিবির জন্য লজ্জাজনক। শুধু তা- নয়, সংশ্লিষ্ট অংশীজন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে কোনোপ্রকার বিচার-বিবেচনা না করেই এক পক্ষের আবদারের দোসর হওয়া পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই না।

একইসঙ্গে তা নজিরবিহীন রক্তপাত প্রাণহানির বিনিময়ে অর্জিত অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে শুধু সাংঘর্ষিকই নয়, প্রতারণাও বটে।

বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত গতকালের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অবস্থান স্পষ্টভাবে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে বাংলাদেশে সহিংসতা, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নেই। যারা ঐক্য, শান্তি আইনশৃঙ্খলার বিনষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আমরা সরকারের বার্তাকে সময়োপযোগী হিসেবে স্বাগত জানাই।

তবে উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, এতে দৃশ্যত সচেতনভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পরিচয় হিসেবে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। যা জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত প্রধান উপদেষ্টার গত ২৫ আগস্টের ভাষণে আদিবাসী পরিচয়বিষয়ক শব্দচয়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদি এটি সচেতনভাবেই ঘটে থাকে, তাহলে কি এর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী এজেন্ডা বয়ানের প্রতিফলন ঘটেছে বলে ধরে নিতে হবে না?’

আদিবাসী পরিচয়ের বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা ও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক চর্চার অনুসরণে অবস্থান নির্ধারণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আদিবাসী পরিচয় ব্যবহারের বিরোধী অন্য সব অংশীজনদের প্রতিও আমাদের একই আহ্বান।

 

 

 

আদিবাসী নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা, স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টিকে বাহাসে আমন্ত্রণ

 


আদিবাসী মানে ভূখণ্ডে আদিতে আসছে—এরকম মূর্খ ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে। যারা এ ধরণের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করছে সেই স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টিকে উন্মুক্ত বাহাসে আমন্ত্রণ জানাই। বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি), বিকেলে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

এনসিটিবির সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তিনজন শিক্ষার্থী, সংক্ষুদ্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা ও সাংবাদিকদের ওপর হওয়া হামলার ঘটনার নিন্দা ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিভাগটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

বিক্ষোভে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ৩ জন শিক্ষার্থীসহ যাদের ওপর হামলা করা হয়েছে, যারা এখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছে, এই হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ঘৃণা ও ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের নাই। আমরা তাদের গ্রেপ্তার ও যৌক্তিক শাস্তির দাবি জানাই।

তিনি আরও বলেন, আজকে পাঠ্যবই থেকে আদিবাসীদের যে স্বীকৃতি তা ছিড়ে ফেলা হয়েছে। এমনকি তাদের সহ্য করাও হচ্ছে না। বাংলাদেশের ৬১টি জেলায় সিভিল শাসন কিন্তু তিন পার্বত্য জেলায় নির্জলা সেনা শাসন। এটা কোনোদিন আমরা বরদাস্ত করতে পারি না। একটা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি আছে তাদের  আদিবাসী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না এই বলে যে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী। পাহাড়ে তাদের জমি উৎখাত করা হচ্ছে আবার এখন সমতলেও তাদের উপর হামলে পড়া হচ্ছে। দ্রুত এই হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সেলের সদস্য মীর আরশাদুল হক বলেন, তারা রূপাইয়্যা শ্রেষ্ঠার ওপর এমনভাবে হামলা করেছে যে তার মাথায় ১২টি সেলাই লেগেছে। এই রূপাইয়্যা অভ্যুত্থানের সময় মোহাম্মদপুর থেকে নিয়মিত আন্দোলন করেছে। তাঁর ভাইকে স্থানীয় কাউন্সিলর তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছে।

বিক্ষোভ সমাবেশে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক খান, সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম, সাইফুল আলম চৌধুরী, কাজলী শেহরীন ইসলাম, সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী, সহকারী অধ্যাপক মার্জিয়া রহমানসহ বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

আদিবাসী ছাত্র-জনতার ওপর হামলার প্রতিবাদে রাবিতে মশালমিছিল

 


ঢাকার মতিঝিলেসংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতারওপর হামলার প্রতিবাদে মশালমিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের শহীদ শামসুজ্জোহা চত্বর থেকে মশালমিছিলটি শুরু হয়।

ক্যাম্পাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে মিছিলটি শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক চত্বরে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। রাত পৌনে আটটা পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলে।

সমাবেশ থেকে বিক্ষোভে হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসী শব্দসংবলিত গ্রাফিতির ছবি পুনর্বহাল এবং স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি নামের সংগঠনকে উগ্রবাদী আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধের দাবি জানান তারা।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর তাঁরা আশা করছিলেন সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, বহুমাত্রিক, বৈষম্যহীন অন্তর্বর্তীমূলক বাংলাদেশ গঠিত হবে। কিন্তু সবার মুখে শুধু বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার কথার ফুলঝুড়ি, বাস্তবে কথার কোনো প্রয়োগ নেই। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও তাঁরা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাননি।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি শাকিল হোসেন বলেন, ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী তো পাঠ্যবইয়ে আদিবাসী শব্দসংবলিত গ্রাফিতি যুক্ত করতে বলেনি। সরকারই যুক্ত করে আবার সেটা বাতিল করল। তাহলে ওনারা কী এর দায় নেবে না? আসলে ওনারা মূলত বিভাজনের রাজনীতি করে, বিভাজনের মধ্য দিয়ে মানুষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফায়দা নিতে চায়।

চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি বিজয় চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে সংহতি জানিয়ে আরও বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) আহ্বায়ক রাকিব হোসেন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জুস্মিতা সরেন, ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ছয়েস তালুকদার, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী তুহিন চাকমা প্রমুখ।

আদিবাসীদের উপর হামলায় আটক ২ জনের মাথায় আঘাতের চিহ্ন নেই


ঢাকার মতিঝিলে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনার পর স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির দুই নেতা আরিফ আল খবির ও মো. আব্বাসের মাথায় ব্যান্ডেজ পরা দেখা গেলেও, তাদের গ্রেপ্তারের পর কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তারা দুজন আহত নন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) মতিঝিল থানার ওসি মেজবাহ উদ্দিন গণমাধ্যমকে কথা জানান। তিনি আরও জানান, ‘সুস্থ অবস্থাতেইদুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনার জন্য মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

এনসিটিবি ভবনের সামনে বুধবার আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক মারধরের অভিযোগে ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে তাদের কপাল মাথার অংশে ব্যান্ডেজ পরা দেখা গেছে।

পাঠ্যবই থেকেআদিবাসীশব্দযুক্ত চিত্রকর্ম বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে পাঠ্যপুস্তক ভবনের সামনেসংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতাব্যানারে অবস্থান নেওয়াদের ওপর হামলা চালায় চিত্রকর্মটি বাদ দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়াস্টুডেন্টস ফর সভরেন্টিনামের একটি সংগঠন।

ওই ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে রাতেই দুই 'হামলাকারীকে' গ্রেপ্তারের তথ্য দেওয়া হয় সরকারের দুই উপদেষ্টার তরফ থেকে।

পরে বৃহস্পতিবার ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াদুর রহমানের আদালত শুনানি শেষে আটক দুজনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। 

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে দিন তাদের ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক কাজী আরমান হোসেন তাদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। আসামি পক্ষের আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধীতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাদের জামিন নাঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। 

© all rights reserved - Janajatir Kantho