গ্রীষ্মের তাপদাহে পাহাড়ে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার

পাহাড়ে পানির অভাব

গ্রীষ্মের তাপদাহে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। অনাবৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ছড়াগুলো শুকিয়ে গেছে। পানির সংকটে হা-হুতাশ করছেন পার্বত্যবাসী।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের চিম্বুক সড়কের গেৎশিমানী বম পাড়ার বাসিন্দারা চার ফুটের মতো মাটি খুঁড়ে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। পাড়ার প্রায় ৮০টি পরিবার এ পানির উপর নির্ভরশীল। দৈনন্দিন নানা কাজের পাশাপাশি এ পানি পান করা হয়। একজনের পর আরেকজন সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করেন। কিন্তু এ পানি পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

তীব্র পানির সংকটে চিম্বুক পাহাড়ের কোরাং বাজার এলাকায় পানি বিতরণ করে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এ এলাকায় ম্রো জনজাতির ২১০টি পরিবারের বসবাস রয়েছে।

পানির জন্য হাহাকারের এ চিত্র কেবল বান্দরবানেই নয়। অনাবৃষ্টির ফলে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক ছড়া শুকিয়ে গেছে। উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের শিলছড়ি ছড়া, ভেলাপ্পা পাড়া ছড়া এবং ৩ নং চিৎমরম ইউনিয়ন ৩ নং ওয়ার্ডের জামাইছড়ি এলাকার ছড়াগুলো শুকিয়ে গেছে। ফলে সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন হাজারও এলাকাবাসী।

কিছু কিছু এলাকায় গভীর নলকুপ থাকলেও ছড়ায় পানি না থাকায় পানির স্তর নীচে নেমে গেছে। ফলে নলকূপেও পানি উঠছে না। এতে করে নদী হতে খাবার পানি এবং ব্যবহারের পানি সংগ্রহ করে এলাকাবাসীকে নিত্য প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি কাজ সারতে হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, সাধারণত মার্চ থেকে জুনের আগপর্যন্ত ছড়াগুলোতে পানি থাকে না; থাকলেও অল্প। তবে চলতি বছরের অবস্থা ভয়াবহ। দাবদাহে ছড়াগুলো পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। এতে পাহাড় সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পানির জন্য এই হাহাকার নিয়ে পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড়ে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়ের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। যার কারণে পানির উৎসও কমে গেছে। এ ছাড়া পাহাড় থেকে পাথর তোলা ও পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো ধ্বংস করায় দুর্গম এলাকাগুলোতে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। 

রাজশাহীতে বৃষ্টির আশায় আদিবাসী রীতিতে ব্যাঙের বিয়ে

ব্যাঙের বিয়ে, বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে

তীব্র তাপপ্রবাহে স্বস্তির বৃষ্টির আশায় আদিবাসী রীতিতে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২ মে) রাজশাহীর পবা উপজেলার ভুগরইল খ্রিস্টানপাড়ায় আদিবাসী রীতিতে ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন স্থানীয় আদিবাসীরা।

দুটি ব্যাঙের মধ্যে একটির নাম রাখা হয় শিমুল, আর অপরটির নাম মেঘলা। ব্যাঙের বিয়ের খবরে ভুগরইল আদিবাসী পল্লীতে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। শিমুল আর মেঘলার বিয়ে দেখতে ভিড় করেন গ্রামবাসী।

শিমুলকে সাজিয়ে-গুজিয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে-তালে নাচে গানে কনে মেঘলার বাড়িতে রওনা হয় গ্রামবাসী। ডনবক্স চার্চ থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে কনে পক্ষের বাড়ি। কনে মেঘলার বাড়িতে অতিথিদের নিয়ে বর শিমুল পৌঁছালে সেখানে বিয়ে পড়ানো হয় দুজনার। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় শিমুলের হাত দিয়ে মেঘলার কপালে সিঁদুর দিয়ে দেওয়া হয়।

গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে এ বিয়ের আয়োজন করেন অঞ্জলী বিশ্বাস। তিনি স্থানীয় ডনবক্স চার্চে শিশুদের শিক্ষাদান কর্মসূচির শিক্ষক এবং বর শিমুলের অভিভাবক।

অন্যদিকে, আদিবাসী পরিবারের অনার্স পড়ুয়া জয়া বিশ্বাস কনে পক্ষের অভিভাবক। তার বাড়িতেই বিয়ে পর্বের আয়োজন করা হয়।

বিয়ে শেষে শিমুল ও মেঘলাকে চার্চে নিয়ে এনে মাটির একটি গর্তে পানি দিয়ে তাতে আয়োজন করা হয় বর-কনের বাসরের। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ব্যাঙের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।

অঞ্জলি বিশ্বাস বলেন, ‘পুরো বিয়েটাই আয়োজন করা হয়েছে আদিবাসী রীতিতে। বৃষ্টির প্রয়োজন আছে। রোদ আর গরমে মানুষজন ও পশুপাখি থাকতে পারছে না। এজন্য আমরা চাচ্ছি যাতে অন্তত বৃষ্টিটা হয়।

অনাবৃষ্টি বা খরা দেখা দিলে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যুগ যুগ ধরে এভাবেই ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বৃষ্টির প্রত্যাশা করা হয়।  

প্রীতি ওরাং হত্যার বিচার বিশেষ আদালতে করার দাবি

প্রীতি ওরাং হত্যা, ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক

ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসার কাজে নিয়োজিত শিশু গৃহশ্রমিক প্রীতি উরাং হত্যার বিচার বিশেষ আদালতে করার দাবি জানানো হয়েছে।

আজ বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মহান মে দিবস উপলক্ষে জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন আয়োজিত এক গৃহশ্রমিক সমাবেশে সংগঠনের পক্ষে থেকে এ দাবি জানানো হয়।

সংগঠনের সভাপতি মমতাজ বেগমের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড আনিসুর রহমান মল্লিক, সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড আবুল হোসাইন, সংগঠনের উপদেষ্টা কমরেড মোস্তফা আলমগীর রতন, কমরেড জাকির হোসেন রাজু প্রমুখ।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, আজ মহান মে দিবস। আজ থেকে ১৩৮ বছর আগে আমেরিকার সিকাগো শহরে শ্রমিক নেতারা দাবি করেছিল ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা শিক্ষা ও বিনোদন। ১৩৮ বছর পরও বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকেরা ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের অধিকার থেকে বঞ্চিত। গৃহশ্রমিকরা সুরক্ষার মধ্যে না থাকার কারণে তারা নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যার শিকার হচ্ছে। এই শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য শ্রম আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প নাই।

নেতৃবৃন্দ গৃহশ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি জানান।

সমাবেশ শেষে একটি শোভাযাত্রা নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সংগঠনের কার্যালয়ে এসে শেষ হয়। 

‘দুই বছরের দুধের বাচ্চা কীভাবে কেএনএফ সন্ত্রাসী হয়’

কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ

বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) দমনের নামে যে যৌথ অভিযান চালানো হচ্ছে, এতে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। দুই বছরের দুধের বাচ্চা কীভাবে কেএনএফ সন্ত্রাসী হয়—প্রশ্ন তুলেছেন আদিবাসী ছাত্র-যুব নেতারা।

আজ বিকেলে ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে কেএনএফ দমনের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি বন্ধের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে তারা এমন কথা বলেন। আদিবাসী ছাত্র ও যুব সংগঠনসমূহের ব্যানারে এ মানববন্ধন হয়।

সভাপতির বক্তব্যে আন্তোনি রেমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে কেএনএফ-এর মতো সশস্ত্র সংগঠনের সৃষ্টি হতো না। শান্তিচুক্তির এতো বছরের অবহেলার কারনেই কেএনএফ-এর সৃষ্টি হয়েছে। কুচি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রধান নাথান বমকে গ্রেপ্তার করতে না পারার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে।   

আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অলিক মৃ বলেন, দোষ করেছেন একজন আর সেই দোষ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে গোটা জাতিগোষ্ঠীর উপর। কেএনএফ দমনের নামে একটা জাতিকে নির্মূল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছি বান্দরবানে।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মশিউর রহমান সংহতি জানিয়ে বলেন, ইরাকে প্রেসিডেন্ট বুশের সন্ত্রাস দমন আর বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস দমনের চরিত্র একই। সন্ত্রাস দমনের নামে যখন গোটা মুসলমানদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচিত করানো হয়, তখন বম জনগোষ্ঠীকেও সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সাধারণ বমদের গ্রেপ্তার করে কেএনএফ বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা অন্যায়।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ছাত্র-যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং বলেন, যারা সত্যিকারের অপরাধী তাদের খুঁজে বের করুন। অপরাধীদের শাস্তি হোক। সবাইকে এক পাল্লায় মাপা যাবে না।  

মানববন্ধনে আদিবাসী যুব ফোরাম, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, আদিবাসী যুব পরিষদ, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস), বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিলের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। 

রাষ্ট্র বনাম চেতনা

আদিবাসী জনগোষ্ঠী কারা


প্রিয় লেখক কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তার ‘পাহাড়ী জনপদে জীবনের অন্বেষা’ প্রবন্ধে লিখেছেন

‘‘কথা ছিল বাংলাদেশের ভাগে যে আকাশটুকু পড়েছে তার অধিকার সব মানুষের সমান থাকবে। থাকেনি।

কথা ছিল দেশের প্রধান জাতিসত্তার মানুষের পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকবে। থাকেনি।

কথা ছিল সামরিক বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে না পাহাড়ী মানুষের জীবন। হয়নি।

কথা ছিল একটি শান্তি চুক্তির সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়ে পরিপূর্ণ শান্তি আনা হবে বিদ্রোহী জনপদের অশান্ত মানুষের হৃদয়ে। হয়নি।

কথা ছিল সব নৈরাজ্যের অবসান শেষে পাহাড়ী আদিবাসীদের মর্যাদা সমুন্নত হবে। হয়নি।’’

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার আইএলও কনভেশন নং-১০৭ র‌্যাটিফাই করেন। এই কনভেনশনে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমির মালিকানা ও অধিকার স্বীকৃত। দুঃখের বিষয়, এই কনভেশনের আলোকে এখনো এই রাষ্ট্র সরকার কনভেনশন বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কনভেনশনে বলা আছে, আদিবাসীদের কাগজ ও দলিল থাকুক বা না থাকুক যে জমি তারা ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করে আসছে সে জমির অধিকার তাদের, মালিকানা তাদের। বঙ্গবন্ধুর পর বাকি সরকারগুলো বাকি কাজগুলো আর করেনি। মুদি দোকানির মতো বাকি রেখে দিয়েছেন।

১৯৬২ সালের তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে ৮ ফুট উঁচু কাঁটাতাঁরের বেড়া নির্মাণ করেছিলেন ৬০ কি.মি মধুপুরের শালবনে। ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সৈনিক এম এল প্রশান্ত তার ফিরে দেখা নামক লেখায় জানিয়েছেন, ‘মধুপুরে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের কাজ ২০০২ থেকেই শুরু করে বনবিভাগ। রসুলপুর থেকে মাপ যোগ করে আদিবাসী গ্রাম সাঁতারিয়া পর্যন্ত যখন পৌঁছে তখন স্থানীয় জনগণ বাধা প্রদান করে। এতে নেতৃত্ব দেন যতীশ দফো, ইলিপ চাম্বুগং, মার্থা চাম্বুগংসহ আরো কয়েকজন। এপ্রিলের ২০০৩ সালে আবার দেয়াল নির্মাণ কাজ শুরু করেন এইসব পয়েন্টগুলোতেরসুলপুর, সাতারিয়া, জালাবাদা, সাধুপাড়া, কাকড়াগুনি, লোহরিয়া, ধলিবাইদ বাদরবাগ।’

আবিমার সকল সংগঠন নিজেদের অস্তিত্ব ভূমি রক্ষার জন্যে সংঘবদ্ধ হতে থাকে এবং মিছিল মিটিং মানববন্ধন শুরু করে। অপর দিকে বনবিভাগ শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সপ্তাহব্যাপী সকল এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলিত হয়। কালো পতাকা উত্তোলন করে ০৩/০১/২০০৪ তারিখ শান্তিপূর্ণ মৌন মিছিল বের হয়। সাধুপাড়া জালাবাদা হয়ে গায়রা স্কুলে হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম, সমাবেশ হয়। সমাবেশ শেষের মিছিল রাজঘাট নামক স্থানে পৌঁছালে বিনা প্ররোচনায় বনরক্ষক ও পুলিশ মিলিত প্রয়াসে বিনা উস্কানিতে গুলি বর্ষণ করে। ঘটনাস্থলেই মারা যান শহীদ পিরেন স্নাল, চির পঙ্গুত্ব বরণ করেন গারো যুবক বীর উৎপল নকরেক। এসময় অর্ধ-শতাধিক গুলিবিদ্ধ হন। স্বাধীন রাষ্ট্রের এমন বর্বর নৃশংস আচরণ ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ। এটি মহান ৭১-এর চেতনার পরিপন্থী।

ইতিহাস নাড়াচাড়া করে আমরা দেখতে পাই, অতীতে আদিবাসীদের একের পর এক মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। বর্তমানে আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে জমি ভূমি, বসতভিটা। হরণ করা হয়েছে আদিবাসীদের সরকারী চাকুরিতে প্রবেশের কোটা পদ্ধতি। আদিবাসী বান্ধব সরকার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ সরকার আদিবাসীদের নিয়ে রাজনীতির গুটি নাড়ছে।

আদিবাসী অধ্যুষিত মধুপুর শালবনের দোখলায় বাংলাদেশের সংবিধানের প্রাথমিক খসড়া রচিত হয়েছিল। কত যন্ত্রণায় প্রাপ্ত সেই সংবিধানে ঠাঁই হয়নি মধুপুরে অবস্থিত গারো তথা সমগ্র আদিবাসীর আত্মপরিচয় এবং ভূমির অধিকার। এই রাষ্ট্রের বর্তমান ৭১-এর চেতনা নামক ফুলের স্ফুলিঙ্গ ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে একাত্তরের প্রকৃত আদর্শধারীরা। একাত্তরের চেতনা কি এই ছিল যে, ধর্ম ব্যক্তি পর্যায় পেরিয়ে রাষ্ট্র ধর্মান্তরিত হোক? রাষ্ট্রের ধর্ম হোক একটা গোষ্ঠীর! আজ অসাম্প্রদায়িকতা কোথায়? আমি খুঁজে বেড়াই।

রাষ্ট্রকে ধর্মান্তরিত করার এমন আচরণে অনেক মুক্তিযোদ্ধা চুপ ছিলেন। মৌন ছিলেন তথাকথিত আদিবাসী সরকারি নেতারাও। আবার আদর্শিক গুটি কয়েক মুক্তিযোদ্ধারা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ধর্মের জন্যে আমরা অস্ত্র নিয়ে দেশ স্বাধীন করিনি। এখানে গান্ধীজীর একটা কথা স্বরণযোগ্য, ‘‘কোন দেশ কতটা সভ্য, তা বোঝার একটা পথ হলো সে দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থান দেখা, তারা কতটুকু নাগরিক অধিকার ভোগ করে তার পরিমান জানা।’’ গান্ধীর এই উক্তির মাপকাঠিতে পরিস্কার দেখা যায় এই রাষ্ট্রের প্রকৃত চেহারা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানা জুড়ে স্বাধীনতার সুবাতাস বইলেও আদিবাসীদের গায়ে সেই বাতাস লাগে না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, আদিবাসী অধিকারের জন্য যে লড়াই তা গারো বা মারমা ত্রিপুরা চাকমাদের একার নয়, এটা সমগ্র জাতির সামষ্টিক লড়াই। রাষ্ট্র যতো এই উপলব্ধি করবে ততোই সে উন্নত হবে।

এদেশে যুগ যুগ ধরে আদিবাসীরা বৈষম্য বঞ্চনার শিকার। বঞ্চনায় গ্রাস করা হয়েছে আদিবাসীদের অস্তিত্ব। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রত্যেক সরকারই তাদের সুবিধা মতোন আদিবাসীদের ব্যবহার করেছে। নির্বাচন আসলে একগাদা ইশতেহার দিয়ে বাদঁর নাচা নাঁচায়, বাস্তবে অধিকার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ ছিঁটেফোটাও নেই। পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হলে কোনো জাতিগোষ্ঠীকে অবহেলা বা তুচ্ছ জ্ঞান করে রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারবে না। সবাই এগিয়ে গেলেই রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে এগোতে হলে আদিবাসী সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। এটি ভাবনার বিষয়।

বাঙালি পাকিস্তানের জাতি-ভাষাগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার অর্জন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই বাঙালিই আদিবাসীদের ওপর একই নিপীড়ন চালাচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা কলুষিত।

মহান সংবিধানকে এই সত্য মানতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্মের বৈচিত্র্যপ‚র্ণ দেশ। সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তা বিশিষ্ট বাঙালি জাতির মতো মিথ্যা কলুষিত অসত্য বাক্য। এর বিপরীতে বলতে হয়, বাংলাদেশ কোনো একক ভাষা, একক জাতির রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আরও জাতির মানুষ বসবাস করে, তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা আছে এবং সে ভাষায় তারা কথা বলে। সংশোধিত সংবিধানে দেশের অন্য ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষাকে পরিত্যাজ্য করা হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে এক ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করে আঘাত করা হয়েছে দেশের বহু মাত্রিক বৈচিত্র্যকে। মাতৃভাষার জন্যে যারা রক্ত দিয়েছে তাদের কাছেও অন্য মাতৃভাষা নিরাপদ নয়। বিষয়টা ভাবতেই কষ্ট লাগে। এ লজ্জা কার? এদেশের বর্তমান রীতিনীতি এদেশের ম‚ল চেতনারই পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেশে দুর্নীতিই এখন নীতি। রাষ্ট্র বনাম চেতনা সাংঘর্ষিক।

লেখা শেষ করতে চাই প্রিয় কবি লেখক রফিক আজাদের কবিতা দিয়ে। ১৯৭৬ সালের মে মাসে রফিক আজাদ রচনা করেছিলেন মধুপুরের শালবনের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবিতাটি

‘‘স্পর্শকাতর এই নাম

উচ্চারণ মাত্র যেন ভেঙে যাবে,

অন্তর্হিত হবে তার মহিমা-

চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে ভেতরে

খুব শক্তিশালী

মরণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।

মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।

চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্ত স্নিগ্ধ পূর্নিমার চাঁদ।

চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি।

চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।

চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।’’

কবির সময়ের উপলব্ধি, তিনি হিংস্রতা দেখেনি! কবি কি জানে বর্তমানে কত হিংস্রতায় ভরা চুনিয়া? ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার জাতীয় উদ্যান গড়েছিল গারো কোচদের ভূমিতে। কাগজে কলমে এর লক্ষ্য উদ্দেশ্যে ছিল বন সংরক্ষণ উন্নয়ন। বাস্তবে ছিল গারো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা এবং তা কার্যসিদ্ধির জন্য পাকিস্তান সরকারের পর এই স্বাধীন বাংলার সরকার ২০০৪ সালে যে বর্বরতা দেখিয়েছে তা এক ভয়ানক হিংস্র রূপ। এজন্যেই আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং আক্ষেপে বলেছেন, ‘মধুপুর জাতীয় পার্ক এখন বাইরের আমোদ প্রিয় লোকদের বনভোজন ও আনন্দ ভ্রমণের জন্যে উপযুক্ত জায়গা, আদিবাসীদের জন্য অনুপযুক্ত। বনের আদি অধিবাসী গারো, কোচদের জীবন হুমকিতে।’

লেখক: নিগূঢ় ম্রং, কবি ও লেখক। 

‘কেএনএফ দমনে নিরীহ মানুষ যেন হেনস্তার শিকার না হন’

কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিরুদ্ধে পরিচালিত যৌথ অভিযানে কোনো নিরীহ মানুষ যেন হেনস্তার শিকার না হন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি।

আজ মঙ্গলবার কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনস্থ কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

জানা গেছে, বৈঠকে বান্দরবানের থানচি ও রুমায় কেএনএফের ব্যাংক ও অস্ত্র লুট এবং তাদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে বলা হয়, ওই ঘটনার পর থেকে সশস্ত্র ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। ঘটনার পর থেকে পাহাড়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অভিযানে যাতে কোনো সাধারণ মানুষ হেনস্তার শিকার না হন, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়।

কমিটির সদস্য জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) ও সুদত্ত চাকমা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। আহ্বায়কের বিশেষ আমন্ত্রণে পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এবং পার্বত্য চট্রগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

কমিটির গত বৈঠকে পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার করা ২৪০টি ক্যাম্পে পুলিশ মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আজকের বৈঠকে এই বিষয়ে পুলিশের বদলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈঠকে ভূমি সচিব জানিয়েছেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা প্রণয়নের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। পার্বত্য অঞ্চলে ডিজিটাল ভূমি জরিপ কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তাব করেন তিনি। এ ছাড়া বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের শূন্য পদে পার্বত্য অঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসী, যাঁরা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কর্মরত আছেন, এমন কর্মকর্তাদের প্রেষণে পদায়নের কাজ অব্যাহত রাখার সুপারিশ করা হয়।

এ ছাড়া বৈঠকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত বিভাগ/দপ্তরগুলোর বিষয়ে সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে আলোচনার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। 

পাহাড়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

পাহাড়ে শান্তি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। দেশের মানবাধিকার সংগঠনের জোট হিউম্যান রাইটস ফোরামের একটি প্রতিনিধি দল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করতে গেলে কমিশনের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন।

কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইউশা রহমান জানান, হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের (এইচআরএফবি) প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে যান। এ সময় কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা, পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) মো. আশরাফুল আলম, পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) কাজী আরফান আশিক উপস্থিত ছিলেন।

এসময় প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে তাদের বক্তব্য এবং কমিশনের সহায়তায় বিভিন্ন ধরণের কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।

প্রতিনিধি দলে নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, মানবাধিকারকর্মী তামান্না হক রীতি ও কাপেং ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা উপস্থিত ছিলেন।

আলোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ। প্রতিনিধিদলের উপস্থাপিত দাবীর প্রেক্ষাপটে কমিশনের চেয়ারম্যান পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ, সহিংসতামুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। 

© all rights reserved - Janajatir Kantho