এ নিয়ে গারো নেতৃবৃন্দ ও চলেশের পরিবারের সদস্যদের
মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বন মামলা সহ অন্য অনেক ইস্যুর ভিড়ে চলেশের ফাইলও চাপা পড়ে গেছে।
২০০৩ সালের মাঝামাঝিতে ‘ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যান্ড
ইকোট্যুরিজম’ প্রকল্পের আওতায় মধুপুর গড়ের তিন হাজার একর বনভূমির চারপাশে প্রাচীর নির্মাণের
উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই দেয়াল নির্মিত হলে ঐতিহ্যগত অধিকার হারানোর আশঙ্কায় আদিবাসীরা
আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা চলেশ
রিছিল।
২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি আদিবাসীদের বিক্ষোভ মিছিলে
বনরক্ষী ও পুলিশ গুলি চালালে পীরেন স্নাল নামের এক গারো যুবক নিহত হন। আহত হন ২৫ জন
নারী-পুরুষ ও শিশু। এই ঘটনার পর আন্দোলন তীব্রতর হলে জোট সরকার প্রাচীর নির্মাণকাজ
বন্ধ রাখে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা
হয়। সারা দেশে মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধ হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মধুপুরের কাকরাইদ
এলাকায় বিএডিসির বীজ উৎপাদন খামারে সেনাক্যাম্প স্থাপন করে। এই সুযোগে বন বিভাগ প্রাচীর
নির্মাণে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। বন বিভাগ দ্রুত গতিতে দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করে।
আদিবাসী নেতারা গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে ক্ষোভের কথা
তুলে ধরেন। জাতীয় কয়েকটি পত্রিকা সংবাদটি প্রকাশ করলে দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় শুরু
হয়। এমন পরিস্থিতি সরকারের বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সি এস করিম সরেজমিন পরিদর্শন করেন
এবং প্রাচীর নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দেন।
কিন্তু বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেনা শাসনের
সময় বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষান্ত থাকেনি। আন্দোলনকারীদের মামলায় জড়িয়ে হয়রানি
শুরু করে।
২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ময়মনসিংহের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান
থেকে মধুপুর যাওয়ার সময় চলেশ রিছিল, প্রতাপ জাম্বিল, তুহিন হাদিমা, পীরেন সিমসাংকে
বেলা ২টার দিকে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মুক্তাগাছা উপজেলার কালীবাড়ী থেকে তুলে
নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকধারী সদস্যরা। তাঁদের আটক করে মধুপুরের বিএডিসির
সেনাক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। দফায় দফায় নিষ্ঠুর
নির্যাতনে চলেশ রিছিল বিকেলের দিকে নিথর হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে মধুপুর হাসপাতালে নেওয়া
হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তৎকালীন মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)
রিয়াজ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘চলেশকে গ্রেপ্তার করতে গেলে দৌড়ে পালানোর সময়
হোঁচট খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারান। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়।’
এ ঘটনায় মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তৎকালীন
জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. কামরুজ্জামান বাদী হয়ে মধুপুর থানায় অপমৃত্যুর মামলা করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ময়নাতদন্তের পর ১৯ মার্চ চলেশের মরদেহ স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করে।
২০ মার্চ তাঁকে সমাহিত করার পর চলেশ রিছিলের স্ত্রী সন্ধ্যা সিমসাং বাদী হয়ে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বন বিভাগের সদস্যদের নাম উল্লেখ করে মধুপুর থানায় একটি হত্যা মামলার
এজাহার দায়ের করেন।
মধুপুর থানা-পুলিশ ওই এজাহার নিয়ম মাফিক গ্রহণ করলেও
মামলা রেকর্ডভুক্ত করেনি। কারণ হিসেবে ওসি রিয়াজ উদ্দিন উল্লেখ করেছিলেন, ‘যেহেতু ইউডি
মামলা হয়েছে, তাই একই ঘটনায় অপর মামলা রেকর্ডভুক্ত করা যায় না।’
গারো রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য করার পূর্বে চলেশের গোসল
করানো হয়। এই কাজে সম্পৃক্ত শষিণ দালবত, জয়ন বাজি ও কলেশ রিছিল ২৪ মার্চ লিখিতভাবে
চলেশের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা উপস্থাপন করেন।
তাঁরা উল্লেখ করেন, ‘চলেশের হাতের ওপরের অংশ সম্পূর্ণ
চুরমার করা হয়েছে। হাতের তালুতে ছিদ্র ছিল। হাত ও পায়ের আঙুলে নখ ছিল না। পিঠের পুরো
অংশ এবং নিতম্বে আঘাতের কারণে রক্তের জমাট ছিল। অণ্ডকোষ মাংসের সঙ্গে মিশে গেছে। হাঁটুর
নিচে অসংখ্য আঘাতের দাগ ও দুটি পায়ের তালু ছিল কালো।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ৫ মে অবসরপ্রাপ্ত
জেলা ও দায়রা জজ মো. রফিউদ্দিনের নেতৃত্বে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি করেন। তিনি তদন্ত
করেন। চলেশের লাশ দ্বিতীয় দফায় উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
রফিউদ্দিনের সেই তদন্ত কার্যক্রমের ফলাফল আজও আলোর মুখ দেখেনি।
দীর্ঘ ১৭ বছরে আন্দোলন থেমে গেছে। মামলা আজও রেকর্ডভুক্ত
হয়নি। বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। এ নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ
বিরাজ করছে।
চলেশের স্ত্রী সন্ধ্যা সিমসাং
বলেন, ‘খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ইউজিন হোমরিক বেঁচে থাকলে হয়তো চলেশের বিচারের একটা ব্যবস্থা
হতো। আমি এবার মধুপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করব। নির্বাচনের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। ১৮ মার্চ পারিবারিকভাবে প্রার্থনা, শ্রদ্ধা
নিবেদন ও সংক্ষিপ্ত আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে মধুপুর থানার পরিদর্শক
(তদন্ত) মুরাদ হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি অনেক দিন আগের। থানায় কখনো কোনো কাজই ঝুলিয়ে রাখা
হয় না। তদন্ত করে কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চলেশ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
শেষে ওই সময়ই আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা বিষয়টি অবহিত নই।’