সংবিধান রাষ্ট্রের নাগরিকের আইনী সনদপত্র।
নাগরিকের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক তথা মৌলিক অধিকারগুলো কী হবে, প্রদত্ত অধিকারগুলো বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এসব সংবিধানে লিখিত অলিখিত বা কনভেনশন আকারে জারি থাকতে পারে।
এটি নির্ভর করে সংবিধানের রূপের (লিখিত/অলিখিত) উপর।
আমরা বাংলাদেশী নাগরিক। আমাদের সংবিধান লিখিত।
রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার অধিকারের কথাগুলো মহান সংবিধানে সুস্পষ্ট আকারে লিপিবদ্ধ থাকবে, থাকাটাই গণতান্ত্রিক সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু সংবিধানে লাঙ্গল চালালে দেখা যায়, দেশের সংখ্যাগড়িষ্ঠ কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া প্রান্তিক বাওয়ালী-মৌয়ালী, জেলে-তাঁতী, চা শ্রমিক, দলিত তথা পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক
মেহনতী মানুষের অধিকারের কথা সংবিধানে যৎসামান্যই লিপিবদ্ধ আছে।
তা-ও যা আছে তার সুরক্ষা বাস্তবায়ন বলার মত নয়।
এখানে প্রান্তিক জনমানুষের কথা পৃথক করে বলা যেতে পারে, যাঁদের সম্মানজনক সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রে।
অস্বীকৃত, সর্বোপরি আত্মপরিচয়হীন অবস্থাতেই তাঁরা বসবাস করেন।
কাউকে পরিচয়হীন করে রাখা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জার বিষয়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাণ-বিনির্মাণ কালের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনজাতির
মানুষের রয়েছে
গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
সংবিধানে জনজাতির পরিচয়কে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে সেইসব ভূমিকাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে।
এভাবে রাষ্ট্রের কোন বিশেষ জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে, বৈষম্য দোষে দুষ্ট হয়ে রাষ্ট্র সমানতালে এগিয়ে যেতে পারবে?
বাংলাদেশের মহান সংবিধানের খসড়াপত্র রচিত হয় গারো, কোচ, বর্মন, মান্দাই অধ্যুষিত মধুপুর শালবনের জঙ্গল পরিবেষ্টিত দোখলা গ্রামে।
এইখানে যেখানে বসে দেশের মানুষের অধিকারের কথা লেখা হল সেখানে মধুপুরের বনবাসী এবং তাঁদের স্বগোত্রীয় মানুষদের অধিকারের কথা সংবিধানে যথাযথভাবে লেখাই হল না! স্থান পেল না! অধিকার প্রাপ্তিতো রীতিমতো অমবস্যার চাঁদ।
এখানে গোড়াতেই সংবিধান সবার হয়ে উঠতে অক্ষম হল। পরিণত হল অগণতান্ত্রিক সংবিধানে।
শালবনবাসীর এই যে সংবিধানে সম্মানযোগ্য জায়গা না পাওয়া কিংবা তাঁদের ন্যায্য অধিকারের কথা না থাকা, না রাখা, এটা কী নিছকই ভুলে যাওয়া বা গাফিলতি? নাকি এর মাঝেই সুপ্ত রয়েছে শাসকগোষ্ঠীর একাধিপত্য প্রতিক্রিয়াশীল দেমাগী উগ্র জাতীয়তাবাদী চরিত্র?
চিহ্নিত করতে হবে গোড়ার গলদ
বেসরকারী হিসাবনুযায়ী বাংলাদেশে ৭২টির মত প্রান্তিক
জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে।
এই মানুষদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবিকারী প্রিয় স্বদেশের জন্য এটা চরম লজ্জাস্কর একটি বিষয়।
১৮ কোটি মানুষের এই দেশ প্রান্তিক এইসব মানুষদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না।
প্রান্তিক জাতিসমূহের স্বীকৃতিহীনতার জের অতি পুরনো। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সূচনার প্রাক্কালিন সময় থেকেই তাঁরা ‘পরিচয় রাজনীতির’ শিকার।
স্বাধীনতাকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সতেরো বার সংবিধান সংশোধন করার প্রয়োজন পরেছে। এরমধ্যে সংবিধানের কোন সংশোধনীতেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিচয়ে সম্মানজনক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি; লক্ষ্য করা যায়নি গুণগত পরিবর্তনের।
বরং স্বীকৃতির বিপরীতে উপনিবেশিক ধারার নিম্নবর্গীয় শব্দ ‘উপজাতি’ ‘ট্রাইব’ ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ ইত্যাদির মতো অবমাননাকর প্রত্যয় জুড়ে দিয়ে অতি সচেতনতার সাথেই আদিবাসী/জনজাতির পরিচয় প্রশ্নটি ধামাচাপা দেয়ার তদবির চালানো হয়েছে।
হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে আদিবাসী ধারণার।
সুখ ও স্বস্তির বিষয়, রাষ্ট্রের তালবাহানা ষড়যন্ত্রের মাঝেও আদিবাসীরা পরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই অব্যাহত রেখেছে, আদিবাসী ধারণার ধারক-বাহক, সমর্থক বাড়ছে।
বাঙালি ভিন্ন জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি কেন নেই এটি পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
স্বাধীন বাংলা শাসন করা সব শাসককেই এই প্রশ্ন সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে দেখেছি।
সাংবিধানিক স্বীকৃতির ইস্যুতে কাউকেই সদয় হতে দেখিনি।
বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে বসা মহাজোট সরকার, পূর্বেকার চার দলীয় জোট সরকার, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামরিক শাসক এরশাদ কিংবা জিয়া কাউকেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইস্যুতে সহনশীল হতে দেখিনি।
সামরিক হোমরাচোমরা কর্তৃক গঠিত জাতীয় পার্টি কিংবা বিএনপিকে বাদ দিলে অপশনে থাকা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক দল বলে দাবিদার আওয়ামীলীগ আদিবাসী ইস্যুতে কী ভূমিকা রেখেছে, দলীয় মনোভাব পদক্ষেপ ইত্যাদি খুঁটিনাটি আলোচনার দাবি রাখে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে আওয়ামীলীগ সরকার ২০১১ সালের ৩০শে জুন তারিখে, সংবিধানের সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে।
এই সংশোধনীতেও আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বরং বাঙালি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে একাধারে আখ্যায়িত করা হয়েছে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে [সংবিধান, ২৩(ক)]। আদিবাসী আত্মপরিচয়কে পাশ কাটিয়ে বাঙালি ভিন্ন জাতিসমূহের পরিচয় তুলে ধরতে যেয়ে পরিচয়ের এতোগুলো বিতর্কিত সাইনবোর্ড রাষ্ট্র স্বয়ং খাড়া করে দিয়েছে।
কিন্তু আওয়ামীলীগ থেকে এ বয়ান ছোড়া হয়, সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধনী) আইন, ২০১১ এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালে গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধানের মূল চেতনা ফিরে এসেছে (ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, মন্ত্রী, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ২০১১)। ’৭২-এর সংবিধান ধারণ, লালন, পুনর্বহাল কিংবা বাস্তবায়ন যদি আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা হয় তবে খতিয়ে দেখতে হয় তথাকথিত বহুল আলোচিত ’৭২র সংবিধান কী বলে, বাঙালি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিষয়ে ’৭২র সংবিধানের অবস্থান।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে জাতীয় গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান যা বাহাত্তরের সংবিধান নামে পরিচিত।
এখানে বলে রাখা ভাল, ১৯৭০ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা, যাঁরা মূলত আওয়ামীলীগ দলের ছিলেন, পাকিস্তানি আমলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই এক অধ্যাদেশ জারি করে গঠন করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলার গণপরিষদ।
পাকিস্তানি আমলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে সদ্যভূমিষ্ঠ স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের জন্যে কেমন জণকল্যাণমূলক সংবিধান রচয়ন হতে পারে তা নিয়ে অনেক দলের মধ্যে মতানৈক্য লক্ষ্য ছিল।
এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ন্যাপ নেতা মোজাফ্ফর আহমেদ গুরুতর একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
আহমদের মতে, ‘আর একটি সাধারণ নির্বাচন না করে দেশের জন্য কোন স্থায়ী সংবিধান গ্রহণ করা যেতে পারে না’। অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও অসাধারণ উপলব্দি থেকে তিনি এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন কিন্তু আওয়ামী প্রাবল্যে প্রস্তাবটি ধোপে টিকেনি।
ফলশ্রুতিতে কোন ধরনের সাধারণ নির্বাচন ছাড়াই পাকিস্তানি আমলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারাই নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য গঠন করা হল গণপরিষদ।
আধুনিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞানুযায়ী যেখানে জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস, জনগণের অংশগ্রহণ শেষ কথা, সেখানে ’৭২-এর সংবিধানে জনগণের অংশগ্রহণ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মতামত অথবা সংবিধান সংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহনের লক্ষ্যে আলাদা কোন ক্ষেত্র বা কাঠামো তৈরী করা হয়নি।
ফলে নতুন দেশের নাগরিকগণ কেমন সংবিধান চান তা জানার কোন সুযোগ থাকল না, জনগণের মতামত ব্যতিরেকে কেবলমাত্র গণপরিষদের সদস্যদের মতামত (দলীয় সদস্যদের মতামতহীন) হয়ে দাঁড়ালো সংবিধান প্রনয়নের একমাত্র পন্থা।
দেখা গেল, বাংলার অন্যান্য জনসাধারণের মতোই বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতামত নেওয়া হয়নি।
অবাঙালি জাতিগোষ্ঠী সংবিধানে চাপিয়ে দেয়া পরিচয় উপজাতি নামেই আখ্যায়িত পরিচিত হল।
লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এই তিনটি মৌল বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছিল।
মুজিবনগর সরকার যখন গঠিত হয় (১০ এপ্রিল ১৯৭১, আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৭ এপ্রিল) তখন এই তিন নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে মুক্তির সংগ্রামকে পরিচালিত করার অঙ্গীকার করেছিল।
দেশ স্বাধীন হলে পর দেখা গেল, সংবিধান রচনায় এই তিন মৌলকে পাশ কাটিয়ে কৃত্রিম চার স্তম্ভ (জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র) জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হল।
এরমধ্য দিয়ে গোড়াতেই স্বাধীন দেশের শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের জনগণকে পাঠিয়ে দিল বোকার স্বর্গে।
যাহোক, সেসময় গণপরিষদের একজন সদস্য হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা (এমএন লারমা) সংবিধান প্রনেতাদের একজন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
জনসাধারনের আইনী অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, নারীর অধিকার, দরিদ্র-বিপন্ন দুস্থ শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার, শিক্ষার অধিকারসহ সকল প্রকার অধিকার রক্ষায় লারমা ছিলেন সোচ্চার কন্ঠ।
গণপরিষদে তাঁর বক্তৃতাগুলোর দিকে নজর দিলে তা-সহজেই অনুমান করা যায়।
বাঙালিকরণের ’৭২-র
সংবিধান
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদ অধিবেশনের একটি বিখ্যাত অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বাংলাদেশের বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব নির্ধারণ সংক্রান্ত আলোচনা।
খসড়া সংবিধানে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত প্রস্তাবে বলা ছিল- ‘নাগরিকত্ব ৫।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে’। এই প্রস্তাবের বিপরীতে গণপরিষদে আ: রাজ্জাক ভূইঁয়া একটি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেন, তিনি প্রস্তাব করেন, ‘সংবিধান বিলের ৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক; ‘৬।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’। ড. কামাল হোসেন (তৎসময়ের আইন ও সংসদীয় বিষয়াবলি এবং সংবিধান প্রনয়ন মন্ত্রী) এই প্রস্তাবনার সমর্থন করে বলেন, ‘মাননীয় স্পীকার সাহেব, এই সংশোধনী গ্রহণযোগ্য বলে আমি মনে করি এবং এটা গ্রহন করা যেতে পারে’। বাংলাদেশের সকল নাগরিককে একচেটিয়াভাবে বাঙালিকরণে উত্থাপিত এই প্রস্তাবনার ঘোর বিরোধিতা করে গণপরিষদে এমএন লারমা নাতিদীর্ঘ একটি বক্তব্য দেন।
তিনি তাঁর এই বক্তব্যেই সেই ঐতিহাসিক সত্যটি তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা বাঙালি নই’।
মাননীয় স্পীকারের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে (আপনি কি বাঙালি হতে চান না?) লারমা বলেন, ‘মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমাদিগকে বাঙালি জাতি বলে কখনো বলা হয় নাই।
আমরা কোন দিনই নিজেদের বাঙালি মনে করি নাই।
আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে।
আমরা বাংলাদেশের নাগরিক।
আমরা আমাদের বাংলাদেশী মনে করি।
কিন্তু বাঙলি বলে নয়’।
লারমার জোর বিরোধিতা সত্ত্বেও সংশোধনী প্রস্তাবটি কন্ঠ ধ্বনিতে পাশ হয়ে যায়, এখানেই আমরা দেখতে পাই বাঙালির উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রাবল্য।
অ-বাঙালি নাগরিকদের সম্পূর্ণ অধিকার খর্ব করা এই সংশোধনী পাস হয়ে যাওয়ায় লারমা প্রতিবাদ স্বরূপ অনির্দিষ্ট কালের জন্য গণপরিষদ বর্জন করেন এবং কক্ষ ত্যাগ করে চলে যান [বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, খন্ড ২ সংখ্যা ১৩, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭২]।
৭২’র সংবিধানের নাগরিকত্ব।৫ ধারার আলোকে যদি বর্তমান পঞ্চদশ সংশোধনীর নাগরিকত্ব।৬ ধারার ব্যাখা আলোকপাত করতে যাই তবে সেখানে দেখতে পাব বাহাত্তরে জন্ম নেয়া ছোট শিশুটির পরিণত রূপ।
সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীর নাগরিকত্ব।৬ ধারা অনুচ্ছেদ (১) এ বলা হচ্ছে- বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে এবং অনুচ্ছেদ (২)-এ বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।
জাতি, জাতীয়তা এবং পরিচয় পরিচিতির প্রশ্নে ’৭২-র সংবিধান যা বলতে চেয়েছিল তা পরিপুষ্ট আকারে
সামনে হাজির করেছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী।
যার দরুণ বলতে হয়, অবাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে বাঙালিভূক্ত করার পুরনো ষড়যন্ত্রের নব্য একটি প্রক্রিয়ার নাম ৭২’র সংবিধান।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসীদের মতামত না নিয়েই আদিবাসী ইস্যুতে সংশোধনী আনা হয়।
প্রসঙ্গের খাতিরে প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়, একটি দেশের সংবিধান কী করে
সংশোধিত হতে পারে? নূন্যতম একটি গণতান্ত্রিক পন্থায় পার্লামেন্টের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগড়িষ্ঠতা থাকলেই সংবিধান সংশোধন করা যায় না।
সংবিধান সংশোধন করতে হলে অবশ্যই জনগণের অনুমোদন নিতে হবে, জনগণের মতামত নেওয়ার কাঠামো থাকতে হবে।
শুধু আইন সভার সদস্যদের অনুমোদন দ্বারাই সংবিধান সংশোধন করা যায় না।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবের সময়, তার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের যিনি রচয়িতা সেই থমাস জেফারসন সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন, সংবিধান সংশোধন করার এখতিয়ার সাধারণ পার্লামেন্টের হাতে থাকতে পারে না।
ইংল্যান্ডে ম্যাগনাকার্টার মাধ্যমে যে লিমিটেড গভর্মেন্ট বা সীমিত সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেখানেও বলা হয়, রাজা বা সরকারের হাতে এ্যাবসোলেটি ক্ষমতা থাকতে পারে না।
ফলত একটি নূন্যতম বুর্জোয়া গণতন্ত্রেও সংখ্যাগড়িষ্ঠ জনগনের মতামত, পরামর্শ, অনুমোদন ছাড়া সংবিধান সংশোধিত হতে পারে না।
জনগণের অভিপ্রায়ের প্রকাশ যদি সংবিধান হয়ে থাকে তবে, তার স্বাধীনতা রক্ষার সনদ যদি হয় সংবিধান তবে জনগণের উর্ধ্বে কারো অবস্থান হতে পারে না।
জনগণ তার অভিপ্রায় হিসেবে যা ঠিক করবেন সেটা সংশোধনের এখতিয়ার কোনভাবেই আইন সভার নিকট থাকতে পারে না।
কিন্তু আমাদের দেশে পার্লামেন্ট সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশ ভোটের জোরে ইতোমধ্যেই সতেরো বার সংবিধান সংশোধিত হয়ে গেছে, এই সংশোধনীগুলোর সাথে কোন সংশোধনীতেই প্রান্তিক জাতিসমূহের অধিকারের সম্পর্ক নেই।
সংশোধনীগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীবান্ধব নয়।
প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা সংবিধানে যে পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতি চেয়েছে তা উপেক্ষিত থেকেছে।
লেখক:
উন্নয়ন ডি. শিরা, প্রবন্ধকার।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন