প্রাইমারী পড়াকালীন সময় থেকেই গানের সঙ্গে সংসার
তাঁর। স্কুল প্রতিযোগিতা, উপজেলা, জেলা, জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়
জিতেছেন পুরস্কার। পুরস্কারের কথা বলতেই ফাইল থেকে ৩১টি গানের সার্টিফিকেট বের করে
দেখালেন। জানালেন, বাড়িতে আরো আছে অযত্নে অবহেলায়।
সম্প্রতি জনপ্রিয় এই শিল্পীর সাথে গারোদের গানের
জগতে এগিয়ে চলা, ব্যান্ড দলগুলোর জন্ম মৃত্যু, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জনজাতির কন্ঠ’র ভারপ্রাপ্ত
সম্পাদক উন্নয়ন ডি. শিরার সাথে আলাপ হল। আলাপে অকপটে জানালেন নিজের কথা, করলেন শিল্পী-ব্যান্ড
দলগুলোর মান মূল্যায়ন।
জনজাতির কন্ঠ: কেমন আছেন?
টগর দ্রং: ভালো।
জনজাতি: ইদানিং মান্দি কমিউনিটির মধ্যে অনেকগুলো
ব্যান্ড দল দেখতে পাচ্ছি। শিল্পীর দৃষ্টিতে বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
দ্রং: ব্যাঙের ছাতার মতো মান্দি ব্যান্ড দল জন্মাচ্ছে।
এর নেগেটিভ পজেটিভ উভয় দিক আছে। অনেকে শখের বশে, দেখাদেখি থেকে আবার অনেকে প্রতিযোগিতা
থেকে ব্যান্ড দল তৈরী করছে। গানের প্রয়োজনে ব্যান্ড দল তৈরী হচ্ছে না। দেখুন, সব প্রতিযোগিতা
পজেটিভ ফলাফল বয়ে আনে না। আপনি যে কাজটা পারেন না বা করার দক্ষতা নেই, সেই কাজে লাভের
চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মান্দিদের অনেক ব্যান্ড দল আছে, যাদের ফাউন্ডেশন
নাই। সঙ্গীত জগতে কাজ করতে হলে স্বরগম জানতে হবে। যা অনেকেই জানে না। অনেকে পুংতা গান
গেয়েই বেশি পরিচিত। তাই বলে তাঁদেরকে প্রতিষ্ঠিত বলা যাবে না। মোল্লার দৌঁড় যেমন মসজিদ
পর্যন্তই তাদের দৌঁড়ও ঐ পর্যন্তই।
জনজাতি: তারপরও অনেকে এগিয়ে যাচ্ছে..
দ্রং: হ্যাঁ। অনেকেই ভালো গাচ্ছে। এগিয়েও যাচ্ছে। তবে তাঁরা কতটুকু এগিয়ে যাবে সেখানে আমি সন্দিহান।
জনজাতি: আপনার গানের শুরুর গল্পটা..
দ্রং: প্রাইমারী পড়াকালীন সময়েই গান গাওয়া শুরু
করি। বাবা একটি হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন। সাধের হারমোনিয়ামটি গণ ব্যবহারে ব্যবহারের
অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ছোটকালে ময়মনসিংহ হালুয়াঘাটে নজরুল সঙ্গীতে অপ্রতিরোধ্য ছিলাম।
এমন দিন গেছে গাইলেই প্রথম হতাম! বাংলা গানোদে বাঙ্গাল রাঙবা আঙখোদে হামজা..(হাসি)।
কিন্তু ত্রিশালে গাইতে এসে দ্বিতীয় তৃতীয় হতাম। ত্রিশালে সঙ্গীতের মান ভালো ছিলো।
জনজাতি: শুরুতে আপনি বাংলা গান গাইতেন। মান্দি গান
গাওয়া শুরু করলেন কবে থেকে?
দ্রং: হ্যাঁ। আগে বাংলা গান (নজরুল ও রবীন্দ্র)
গাইতাম। পরে নিজ জাতির লোকদের সাথে গভীর ভাবে মিশে মান্দি গান গাওয়া শুরু করি।
জনজাতি: মান্দি গান গাওয়ার শুরুর দিককার কথা শুনতে
চাই..
দ্রং: ২০০৫/৬ সালের কথা। তখন আমি মান্দি অধ্যুষিত
কালচাঁদপুরে আসি। এখানে এসে দেখতে পাই মান্দিরা নিজ ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষার জন্যে সংগ্রাম
করছে। মান্দি ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি চর্চায় বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছে। এখানে এসে মান্দি
গান গাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। এখানে আচিক স্কুল, আচিক পত্রিকা চলতো। অবলা পাথাং (আচিক
স্কুলের কর্ণধার), অর্পন যেত্রা (আচিক পত্রিকার সম্পাদক), অনিত্য মানখিন, শুভজিৎ সাংমা
(ঢাকা ওয়ানগালার সাবেক নকমা)-র মতোন অনেক সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার
সুযোগ হয়। এখানে এসেই উপলব্ধি করি কেন মান্দি গান গাবো না? জাতিত্ববোধ থেকেই মূলত মান্দি
গান গাওয়া শুরু করি।
জনজাতি: এফ মাইনর নিয়ে আপনার মূল্যায়ন।
দ্রং: এফ মাইনর নিয়ে আমি আশাবাদী। কারণ তাঁরা সবাই
শিক্ষানবিশ। অতি অল্প সময়ে তাঁরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বলা চলে তাঁরা এখন প্রতিষ্ঠিত।
ব্যান্ডের ভোকাল পিংকি চিরান পড়াশুনা করছেন সঙ্গীত নিয়ে, কাজেই প্রত্যাশা অবশ্যই আছে।
মিডিয়ার দিক থেকেও তাঁরা (এফ মাইনর) এগিয়ে আছে। প্রথম নারী ব্যান্ড দল বলেই কিনা সেই
বিতর্কে যেতে চাই না।
জনজাতি: আপনি মূলত একক গান করেন। ব্যান্ড পার্টির
এই যুগে কেন কোন ব্যান্ড দলে নন কিংবা যদি বলি কেন ব্যান্ড দল গড়ে তুলেননি?
দ্রং: সত্যি বলতে আমি আমার যুগোপযোগী পার্টনার পাইনি। কেবল ভালো ভোকাল, ভালো ড্রামার, ভালো গিটারিস্ট মিলেই ব্যান্ড দল গঠন করা যায় না। সবার মাঝে ভালো বোঝাপড়া থাকাটা জরুরি। রাজনীতিতে যেমন আদর্শের মূল্য আছে, তেমনি ব্যান্ড দলেও আদর্শের যোগসূত্র থাকা জরুরি। আদর্শ ব্যতীত দল গঠিত হতে পারে না। হলেও ভেঙে যাবে। যেমন ‘রে রে’ (মান্দি ব্যান্ড) বারবার ভেঙে যাচ্ছে।
জনজাতি: প্রসঙ্গক্রমে ‘রে রে’ যেহেতু আলাপে উঠেই এল, তাদেরকে নিয়ে আপনার কী মূল্যায়ন?
দ্রং: ওদের উপর জনগণের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু তাঁরা
যেভাবে এগোচ্ছে তাতে আমি আশার আলো দেখি না। তাদের নতুন গান আসছে, স্বাগত জানাই। তাদের
লিরিকের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার বলে মনে করি। কারণ অনেক গান অমর হয় সুরে, আবার অনেক
গান অমর হয় লিরিকে। লিরিক ও সুর দুটোতেই তাদের মনোযোগ দেয়া দরকার।
জনজাতি: ব্যান্ড দলে না থেকে একক ভাবে গাইছেন। শ্রোতা
মহলে সাড়া কেমন?
দ্রং: একসময় ব্যান্ড দলের চেয়ে সলো সিঙ্গারদের চাহিদা
বেশি ছিল। তখন ব্যান্ড দল ছিল কম। দিন বদলে গেছে। এখন সলো সিঙ্গাররা ভাত পায় না।
জনজাতি: মান্দি ব্যান্ড দলগুলোর মধ্যে কোন তিনটিকে
এগিয়ে রাখবেন?
দ্রং: এফ মাইনর, সাক্রামেন্ট, রে রে। তবে জুমাং,
ক্রেমলিন তাঁরাও ভালো করছে।
জনজাতি: আপনার বাল্যকালে দেখা মান্দি ব্যান্ড দল?
দ্রং: থাংস্রেক ব্যান্ড। তাঁরা মাইকে কনসার্ট করতো।
তাদেরকে সাউন্ড সিস্টেম ছাড়াই মাইকে স্টেজ পারফর্ম করতে দেখেছি। এমনও হয়েছে ভোকাল একা
মাইকে গান গেয়ে যাচ্ছে অন্যদের সাউন্ড কাভার হচ্ছে না! তবে ঐ সময়ে সমকালীন ইন্সট্র্রুমেন্টগুলো
থাংস্রেক ব্যান্ড ব্যবহার করতো। যা অবাক করার
মতো।
জনজাতি: তিনটি প্রিয় মান্দি গান..
দ্রং: জন থুসিনের দিং দিং আপফাদে দিং, হাই সারি
রি নামা, কবি মতেন্দ্র মানখিন লিখিত বাঙ জাবুছিম দুখনি সাগাল বালজ্র্রুয়ে। এই গানগুলো
গারোদের অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে। এখনো দিয়ে যাচ্ছে। এই গানগুলো অমর।
জনজাতি: মান্দিদের মধ্যে গানে যাদু দা (যাদু রিছিল)-র
নাম ডাক বেশ আছে। আপনার চোখে যাদু রিছিল..
দ্রং: (খানিকক্ষণ চুপ থেকে) যাদু ভালো কাজ করছে।
এগিয়ে যাচ্ছে, আরো এগিয়ে যাক। তবে এজ অ্যা সলো সিঙ্গার স্টেজ পারফর্ম করতে হবে।
জনজাতি: আপনার অ্যালবাম সংখ্যা?
দ্রং: দুটি। মিক্সড অ্যালবাম। মাইখো চাইচিয়া, ঢাকা
ওয়ানগালা স্পেশাল-২০১৮। সামনে একক অ্যালবাম করার ইচ্ছা আছে।
জনজাতি: একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন। পারিবারিক জীবনে
আপনারা দুই ভাই, দুই বোন। আপনার বোনেরা এখনো সারি (গারো রীতিতে ভাইয়ের বউকে সারি বলে)
থেকে বঞ্চিত..
দ্রং: (কথা শেষ করতে না দিয়েই) সারি তো এভেলেভেল
(হাসি)।
জনজাতি: আপনার মূল্যবান সময় খরচ করে আলাপ পাড়ার
জন্যে ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা।
দ্রং: আপনাকেও ধন্যবাদ।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন