প্রিয় লেখক কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তার ‘পাহাড়ী জনপদে জীবনের অন্বেষা’ প্রবন্ধে লিখেছেন—
‘‘কথা ছিল বাংলাদেশের ভাগে যে আকাশটুকু পড়েছে তার
অধিকার সব মানুষের সমান থাকবে। থাকেনি।
কথা ছিল দেশের প্রধান জাতিসত্তার মানুষের পাশাপাশি
ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকবে। থাকেনি।
কথা ছিল সামরিক বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে না পাহাড়ী
মানুষের জীবন। হয়নি।
কথা ছিল একটি শান্তি চুক্তির সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়ে
পরিপূর্ণ শান্তি আনা হবে বিদ্রোহী জনপদের অশান্ত মানুষের হৃদয়ে। হয়নি।
কথা ছিল সব নৈরাজ্যের অবসান শেষে পাহাড়ী আদিবাসীদের
মর্যাদা সমুন্নত হবে। হয়নি।’’
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার আইএলও কনভেশন
নং-১০৭ র্যাটিফাই করেন। এই কনভেনশনে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমির মালিকানা ও অধিকার
স্বীকৃত। দুঃখের বিষয়, এই কনভেশনের আলোকে এখনো এই রাষ্ট্র সরকার কনভেনশন বাস্তবায়নে
উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কনভেনশনে বলা আছে, আদিবাসীদের কাগজ ও দলিল থাকুক বা না থাকুক যে
জমি তারা ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করে আসছে সে জমির অধিকার তাদের, মালিকানা তাদের। বঙ্গবন্ধুর
পর বাকি সরকারগুলো বাকি কাজগুলো আর করেনি। মুদি দোকানির মতো বাকি রেখে দিয়েছেন।
১৯৬২ সালের তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে ৮ ফুট
উঁচু কাঁটাতাঁরের বেড়া নির্মাণ করেছিলেন ৬০ কি.মি মধুপুরের শালবনে। ইকোপার্ক বিরোধী
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সৈনিক এম এল প্রশান্ত তার ফিরে দেখা নামক লেখায় জানিয়েছেন,
‘মধুপুরে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের কাজ ২০০২ থেকেই শুরু করে বনবিভাগ। রসুলপুর থেকে মাপ
যোগ করে আদিবাসী গ্রাম সাঁতারিয়া পর্যন্ত যখন পৌঁছে তখন স্থানীয় জনগণ বাধা প্রদান করে।
এতে নেতৃত্ব দেন যতীশ দফো, ইলিপ চাম্বুগং, মার্থা চাম্বুগংসহ আরো কয়েকজন। এপ্রিলের
২০০৩ সালে আবার দেয়াল নির্মাণ কাজ শুরু করেন এইসব পয়েন্টগুলোতে—রসুলপুর, সাতারিয়া, জালাবাদা, সাধুপাড়া, কাকড়াগুনি,
লোহরিয়া, ধলিবাইদ বাদরবাগ।’
আবিমার সকল সংগঠন নিজেদের অস্তিত্ব ভূমি রক্ষার জন্যে
সংঘবদ্ধ হতে থাকে এবং মিছিল মিটিং মানববন্ধন শুরু করে। অপর দিকে বনবিভাগ শত শত মিথ্যা
মামলা দিয়ে হয়রানি করে। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সপ্তাহব্যাপী সকল এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে
কালো পতাকা উত্তোলিত হয়। কালো পতাকা উত্তোলন করে ০৩/০১/২০০৪ তারিখ শান্তিপূর্ণ মৌন
মিছিল বের হয়। সাধুপাড়া জালাবাদা হয়ে গায়রা স্কুলে হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম, সমাবেশ
হয়। সমাবেশ শেষের মিছিল রাজঘাট নামক স্থানে পৌঁছালে বিনা প্ররোচনায় বনরক্ষক ও পুলিশ
মিলিত প্রয়াসে বিনা উস্কানিতে গুলি বর্ষণ করে। ঘটনাস্থলেই মারা যান শহীদ পিরেন স্নাল,
চির পঙ্গুত্ব বরণ করেন গারো যুবক বীর উৎপল নকরেক। এসময় অর্ধ-শতাধিক গুলিবিদ্ধ হন। স্বাধীন
রাষ্ট্রের এমন বর্বর নৃশংস আচরণ ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ। এটি মহান ৭১-এর চেতনার পরিপন্থী।
ইতিহাস নাড়াচাড়া করে আমরা দেখতে পাই, অতীতে আদিবাসীদের
একের পর এক মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। বর্তমানে আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে জমি
ভূমি, বসতভিটা। হরণ করা হয়েছে আদিবাসীদের সরকারী চাকুরিতে প্রবেশের কোটা পদ্ধতি। আদিবাসী
বান্ধব সরকার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ সরকার আদিবাসীদের নিয়ে রাজনীতির গুটি নাড়ছে।
আদিবাসী অধ্যুষিত মধুপুর শালবনের দোখলায় বাংলাদেশের
সংবিধানের প্রাথমিক খসড়া রচিত হয়েছিল। কত যন্ত্রণায় প্রাপ্ত সেই সংবিধানে ঠাঁই হয়নি
মধুপুরে অবস্থিত গারো তথা সমগ্র আদিবাসীর আত্মপরিচয় এবং ভূমির অধিকার। এই রাষ্ট্রের
বর্তমান ৭১-এর চেতনা নামক ফুলের স্ফুলিঙ্গ ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে একাত্তরের প্রকৃত
আদর্শধারীরা। একাত্তরের চেতনা কি এই ছিল যে, ধর্ম ব্যক্তি পর্যায় পেরিয়ে রাষ্ট্র ধর্মান্তরিত
হোক? রাষ্ট্রের ধর্ম হোক একটা গোষ্ঠীর! আজ অসাম্প্রদায়িকতা কোথায়? আমি খুঁজে বেড়াই।
রাষ্ট্রকে ধর্মান্তরিত করার এমন আচরণে অনেক মুক্তিযোদ্ধা
চুপ ছিলেন। মৌন ছিলেন তথাকথিত আদিবাসী সরকারি নেতারাও। আবার আদর্শিক গুটি কয়েক মুক্তিযোদ্ধারা
আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ধর্মের জন্যে আমরা অস্ত্র নিয়ে দেশ স্বাধীন করিনি। এখানে গান্ধীজীর
একটা কথা স্বরণযোগ্য, ‘‘কোন দেশ কতটা সভ্য, তা বোঝার একটা পথ হলো সে দেশের সংখ্যালঘুদের
অবস্থান দেখা, তারা কতটুকু নাগরিক অধিকার ভোগ করে তার পরিমান জানা।’’ গান্ধীর এই উক্তির
মাপকাঠিতে পরিস্কার দেখা যায় এই রাষ্ট্রের প্রকৃত চেহারা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানা
জুড়ে স্বাধীনতার সুবাতাস বইলেও আদিবাসীদের গায়ে সেই বাতাস লাগে না।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, আদিবাসী অধিকারের জন্য
যে লড়াই তা গারো বা মারমা ত্রিপুরা চাকমাদের একার নয়, এটা সমগ্র জাতির সামষ্টিক লড়াই।
রাষ্ট্র যতো এই উপলব্ধি করবে ততোই সে উন্নত হবে।
এদেশে যুগ যুগ ধরে আদিবাসীরা বৈষম্য বঞ্চনার শিকার।
বঞ্চনায় গ্রাস করা হয়েছে আদিবাসীদের অস্তিত্ব। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রত্যেক সরকারই
তাদের সুবিধা মতোন আদিবাসীদের ব্যবহার করেছে। নির্বাচন আসলে একগাদা ইশতেহার দিয়ে বাদঁর
নাচা নাঁচায়, বাস্তবে অধিকার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ ছিঁটেফোটাও নেই। পরিতাপের বিষয় হলেও
সত্য যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হলে কোনো জাতিগোষ্ঠীকে অবহেলা বা তুচ্ছ জ্ঞান
করে রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারবে না। সবাই এগিয়ে গেলেই রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে
এগোতে হলে আদিবাসী সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক স্বীকৃতির
বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। এটি ভাবনার বিষয়।
বাঙালি পাকিস্তানের জাতি-ভাষাগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে
লড়াই করে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার অর্জন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই বাঙালিই
আদিবাসীদের ওপর একই নিপীড়ন চালাচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা কলুষিত।
মহান সংবিধানকে এই সত্য মানতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি
বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্মের বৈচিত্র্যপ‚র্ণ দেশ। সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,
ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তা বিশিষ্ট বাঙালি জাতির মতো মিথ্যা কলুষিত অসত্য বাক্য।
এর বিপরীতে বলতে হয়, বাংলাদেশ কোনো একক ভাষা, একক জাতির রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশে বাঙালি
ছাড়াও আরও জাতির মানুষ বসবাস করে, তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা আছে এবং সে ভাষায় তারা কথা
বলে। সংশোধিত সংবিধানে দেশের অন্য ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষাকে পরিত্যাজ্য করা হয়েছে।
সাংবিধানিকভাবে এক ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করে আঘাত করা হয়েছে দেশের বহু মাত্রিক বৈচিত্র্যকে।
মাতৃভাষার জন্যে যারা রক্ত দিয়েছে তাদের কাছেও অন্য মাতৃভাষা নিরাপদ নয়। বিষয়টা ভাবতেই
কষ্ট লাগে। এ লজ্জা কার? এদেশের বর্তমান রীতিনীতি এদেশের ম‚ল চেতনারই পরিপন্থী হয়ে
দাঁড়িয়েছে। এদেশে দুর্নীতিই এখন নীতি। রাষ্ট্র বনাম চেতনা সাংঘর্ষিক।
লেখা শেষ করতে চাই প্রিয় কবি লেখক রফিক আজাদের কবিতা
দিয়ে। ১৯৭৬ সালের মে মাসে রফিক আজাদ রচনা করেছিলেন মধুপুরের শালবনের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’
কবিতাটি—
‘‘স্পর্শকাতর এই নাম
উচ্চারণ মাত্র যেন ভেঙে যাবে,
অন্তর্হিত হবে তার মহিমা-
চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে ভেতরে
খুব শক্তিশালী
মরণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।
চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্ত স্নিগ্ধ পূর্নিমার চাঁদ।
চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি।
চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।
চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।’’
কবির সময়ের উপলব্ধি, তিনি হিংস্রতা দেখেনি! কবি কি
জানে বর্তমানে কত হিংস্রতায় ভরা চুনিয়া? ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার জাতীয় উদ্যান গড়েছিল
গারো কোচদের ভূমিতে। কাগজে কলমে এর লক্ষ্য উদ্দেশ্যে ছিল বন সংরক্ষণ উন্নয়ন। বাস্তবে
ছিল গারো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা এবং তা কার্যসিদ্ধির জন্য পাকিস্তান সরকারের পর এই
স্বাধীন বাংলার সরকার ২০০৪ সালে যে বর্বরতা দেখিয়েছে তা এক ভয়ানক হিংস্র রূপ। এজন্যেই
আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং আক্ষেপে বলেছেন, ‘মধুপুর জাতীয় পার্ক এখন বাইরের আমোদ প্রিয়
লোকদের বনভোজন ও আনন্দ ভ্রমণের জন্যে উপযুক্ত জায়গা, আদিবাসীদের জন্য অনুপযুক্ত। বনের
আদি অধিবাসী গারো, কোচদের জীবন হুমকিতে।’
লেখক: নিগূঢ় ম্রং, কবি ও লেখক।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন