শিক্ষা ব্যবস্থায় আদিবাসী শিক্ষার্থী: প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা

শিক্ষা ব্যবস্থায় আদিবাসী

বাংলাদেশ বহু জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত দেশ। বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরেও সরকারি গেজেটভূক্ত ৫০টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে এবং গেজেট অন্তর্ভূক্তি বাদেও রয়েছে আরো প্রায় ৫০টির বেশি জনগোষ্ঠী। অথচ নন-গেজেটেড জনগোষ্ঠীদেরও রয়েছে আলাদা ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি। যদিও আজকের আলোচনার বিষয় এটা না, অন্য। শিরোনামে উল্লেখিত আলোচনায় ফিরতে আমাদের বাংলাদেশ সৃষ্টি পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সেই ব্যবস্থাকে ঘিরে গড়ে উঠা কিছু আন্দোলনের দিকে নজর দিতে হবে। এতে হয়তো আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া সহজ হবে।

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় অপ্রাসঙ্গিক ছিল। এগুলোর মধ্যে উচ্চ শিক্ষা সংকোচন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছরে বছরে পরীক্ষা ব্যবস্থা, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধি প্রস্তাবনা অন্যতম। পরবর্তী ছাত্র আদোলনে এসব নীতিমালা বন্ধ করো দেওয়া হয়। বাষট্টি সালের শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল শিক্ষার সংকোচন অবস্থা থেকে মুক্তি এবং শিক্ষাকে সার্বজনীন করা।

সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও ফলাফলের কার্যকারিতা কেমন তার উপর দাঁড়িয়ে আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা যায়। বর্তমান সময়ে শিক্ষা চলছে ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। যেখানে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো একই ধারার শিক্ষানীতি দাবি করে আসলেও সরকার এ বিষয়ে কর্ণপাতে নারাজ। ভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয় যে মূল ধারার শিক্ষানীতি সেখানে রয়েছে এক বিশাল গলদ। এই গলদের মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এবং একূল না অকূল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের।

ঠিক কেমন জটিল প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হচ্ছে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের এই আলোচনায় সরাসরি যাওয়া যাক। বিভিন্ন প্রতিবেদনের দিকে নজর দিলে আপনি কিছু সমীকরণ দেখতে পাবেন যেখানে দেখা যাবে বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ১৬৬টি চা বাগান রয়েছে। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় চা রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম এবং নানা জটিলতার মধ্যেও চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো পর্যায়ে। কিন্তু যাদের শ্রমের বিনিময়ে এই উৎপাদন প্রক্রিয়া তাদের বা সেই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।

শ্রম আইনের (২০০৬) ৯৫ নম্বর ধারার (খ) অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, চা বাগানের শ্রমিকদের ছয় থেকে ১২ বছরের সন্তান যদি ২৫ জনের বেশি হয় তাহলে উক্ত বাগানে ওই সকল শিশুদের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ৯৭ নম্বর ধারায় চা শ্রমিকদের সহজভাবে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস প্রাপ্তির সুবিধার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি বলছে সেদিকে যদি দেখি তবে সেখানে এই সমীকরণের বিপরীতে রয়েছে মাত্র ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অথচ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শ্রম আইন বা প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সারাদেশ ব্যাপী পরিচালিত বহুল আলোচিত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। এর বাইরেও রয়েছে স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরিসংখ্যান, যেখানে  ৫-১৭ বছর শিশুদের মধ্যে ৫০ ভাগ শিশুই খর্বকায় মানে বয়স এবং স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার তুলনায় নানান শারীরিক দুর্বল অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে।

এছাড়াও সবথেকে আশঙ্কাজনক পরিসংখ্যান হলো সারাদেশে যেখানে শিশু শ্রমের পরিমাণ ৬ কি ৭ শতাংশ সেখানে চা বাগানে এর পরিমাণ ২০ শতাংশ। ফলে এই জনগোষ্ঠীর শিশুদের উচ্চ শিক্ষা  গ্রহণ করতে আসার জন্য যে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজন তা থেকে বঞ্চিত হয়ে পিছিয়ে পড়ছে। এছাড়াও আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য যে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে তা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় গেজেটভূক্ত না হওয়ার কারণে। একটি দুঃখ জাগানিয়া তথ্য, ১৬৬ বছরে চা জনগোষ্ঠীদের এই বাংলার ইতিহাসে মাত্র ৪০ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এ হলো মোটামুটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় চা জনগোষ্ঠীদের শিক্ষাগত অবস্থা।

এই পরিসংখ্যান গুলো শুধুমাত্র চা জনগোষ্ঠীদের নিয়ে হলেও এই চিত্র সারাদেশে বসবাসরত বাকি আদিবাসী জনগোষ্ঠীদেরও। আমরা যদি সমতলে বসবাসরত গারো সাঁওতাল মুন্ডা, মাহালী, ওঁরাও হাজংসহ ৩৫টির মতো জনগোষ্ঠীর প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অবস্থানগত জায়গা দেখি তাহলে সেখানে দেখতে পাবো স্কুল সংকট, শিক্ষক সংকট, ভাষাগত জটিলতা এইসব নানাবিধ সমস্যায় আদিবাসী শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে যাচ্ছে।

আদিবাসীদের শিক্ষার এই প্রতিবন্ধকতার পেছনে শুধু রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার অভাব নাকি খোদ রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পলিসিও যুক্ত রয়েছে প্রসঙ্গের খাতিরে এই বিষয়ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এই বিষয়ের উপর আলোচনা করতে গিয়ে স্পষ্ট চোখ রাখতে হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে যেখানে পরগাছার মত করে পাহাড়ি জমি দখল করে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র, যার ফলে শুধু ভূমি হারানোর ফলে সরাসরিভাবে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হচ্ছে।

সাজেক সরকারি প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষিকার সাথে আলাপকালে উঠে আসে অপরিকল্পিত পর্যটনের ফলে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা স্কুল বিমুখ হচ্ছে। পাহাড়ি শিশুদের ২০ টাকা, ৩০ টাকায় পর্যটকদের গাইডার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং পর্যটন কেন্দ্রের রাস্তা গুলোতে চিড়িয়াখানার জন্তুদের মতো করে পাহাড়ি শিশুদের দিকে ছুঁড়ে মারা হয় চকলেট যার ফলে শিশু সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যমূলক এবং পর্যটকদের দাসত্বমূলক আচরণের শিকার হচ্ছে পাহাড়ের আদিবাসী শিশুরা। কিশোর সময়ে মানসিক বিকাশকালে পক্ষপাতী পলিসির ফাঁদে পরতে হচ্ছে পাহাড়ি শিশুদের।

আবার জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে কেমন বরাদ্দ এসেছে এসবের দিকে নজর দিলে দেখতে পাবো গত ২০১৯- ২০ অর্থ বছরে তুলনায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা বেড়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২৪ হাজার ৯৩৭ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৮ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।

বছরের পর বছর ধরে শিক্ষাখাতের বাজেটে আত্মতৃপ্তি ঢেঁকুর তুললে চলে না। ঘুরে ফিরে মোট বাজেটের ১১-১২ শতাংশের মধ্যে বিদ্যমান যার হওয়ার কথা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ এবং মোট জিডিপির ৬ শতাংশ যেখানে আছে ২.০৯ শতাংশ। এর মাঝেও রয়েছে কিছু শুভংকরের ফাঁকি,  অর্থমন্ত্রী বলছেন, সরকারের ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু এরমধ্যে শিক্ষা বহির্ভূত খাতের বরাদ্দও আছে। যেহেতু বাজেট মন্ত্রণালয় ধরে হয় সেখানে  শিক্ষা খাতে কেন আলাদা বরাদ্দ রাখা হবে না এই প্রশ্ন রাখা যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, গত বছর থেকে সরকার বাজেট বরাদ্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকে যুক্ত করে বরাদ্দের হিসাব করছে যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এছাড়াও শিক্ষা  খাতের দুই তৃতীয়াংশ ব্যয় হচ্ছে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা খাতে, আর মাত্র এক শতাংশ ব্যয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পেছনে।

২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট পেশ করা হয় সেখানে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকা যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিলো ৫০ কোটি টাকা। এত অল্প বাজেটে ৩০ লাখ জনগোষ্ঠীর অন্যান্য খাতের পাশাপাশি আলাদা ভাবে শিক্ষা খাতে উন্নয়নের কতটুকু সুযোগ রয়েছে?

আইএলও কনভেশন আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী কনভেনশন ১৯৫৭ ও ১৯৮৯র ষষ্ঠ অংশ অনুচ্ছেদ ২৮ এ বলা আছে, এই সকল জনগোষ্ঠীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং সকল প্রকার সহযোগিতা রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় পাঠদানের কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত চালু হয়েছে মাত্র ৬টি ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু দক্ষ শিক্ষকের অভাব, বাজেটের স্বল্পতা ইত্যাদি নানা কারণে কচ্ছপ গতিতে আগাচ্ছে মাতৃভাষায় শিক্ষার পাঠ।

বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত চিম্বুকে ম্রোদের জমিতে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে যে সংকট রয়েছে, সেখানে কয়েকটি গ্রাম মিলেও একটি সরকারি বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই বা আপনি যদি দেখেন সাজেকের স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীদেও যেখানে ছোট ছোট শিশুরা প্লেকার্ড হাতে বলছে, ‘‘আমাদের মসজিদ চাই না, স্কুল চাই’’। এ সকল প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা কতটা মৌলিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে বা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে?

আলোচনার একটা বিশাল অংশ জুড়ে প্রতিবন্ধকতার কথা বলা হলেও আমাদের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনার দিকে যথেষ্ট নজর দিতে হবে বা যে পদক্ষেপগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত হলেও বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা সম্ভাবনার মুখ  দেখবে। সম্ভাবনার কথা বলতে গেলেই প্রথমে ন্যাশন স্ট্যাট এর ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের সকল জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় যে মূল প্রতিবন্ধকতা তা হলো নিজ মাতৃভাষায় এবং নিজ নিজ সামাজিক সাংস্কৃতিক শিক্ষা নিশ্চিত না করা যার ফলে সম্ভাবনা দেখতে হলে রাষ্ট্রকে ন্যাশনাল টাস্কফোর্স গঠন করে এই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

পাশাপাশি ২০১০র শিক্ষানীতিতে যে সুবিধার কথা বলা হয়েছে সেই সুবিধা গুলোকে অধিকারে রূপান্তর করতে হতে। দেশে যে ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষানীতি চালু রয়েছে এই ব্যবস্থাকে ভেঙে একই ধারার শিক্ষা নীতিতে রূপান্তর করতে হবে। চাকরি, বাজার মুখী বা পণ্য মুখী শিক্ষা না করে মানবিক এবং মৌলিক শিক্ষায় রূপান্তর করতে, আদিবাসী শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিত করতে আলাদা গবেষণা প্রয়োজন, এদিকে রাষ্ট্রকে কড়া নজর দিতে হবে। সাথে শিক্ষাখাতে আর্থিক বাজেট বৃদ্ধির পাশাপাশি সঠিক খাতে ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: প্রত্যয় নাফাক, সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন, চবি সংসদ। 

পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন স্মৃতিরেখা চাকমা

পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন স্মৃতিরেখা চাকমা

বয়ন শিল্পে অসাধারণ অবদানের জন্য ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন স্মৃতিরেখা চাকমা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হলে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে তিনি এ পুরস্কার গ্রহণ করেন।

স্মৃতিরেখা চাকমা কাপড়ে পরিবেশবান্ধব উদ্ভিজ রঙিন সুতির সুতোকে ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি গ্রামীণ মহিলাদের বয়ন শিল্পে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য উজিয়া জাধা নামে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান করেছেন।

তাঁর কাছে আসা প্রশিক্ষণার্থীদের তিনি বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুবিধা দিয়ে এবং এমনকি স্টাইপেন্ড দিয়েও বয়ন ও প্রাকৃতিক রঙের প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিচালনা করেন। যার ফলস্বরূপ তাঁর চারজন প্রশিক্ষণার্থীও জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

শ্রীমতি স্মৃতিরেখা চাকমা ১৯৬৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মহিয়সী এ নারী শৈশবে তার দিদাকে ঐতিহ্যবাহী নাগা পদ্ধতি ব্যবহার করে কটি তাঁতে বুনতে দেখেছেন এবং এখন তিনি এই কাজে তরুণ প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৬৩ বছর।

জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন গাছ, লতাপাতা, বীজ, ফুল, ভেষজ, শেকড়, গাছের ছাল ইত্যাদি পরিবেশ-বান্ধব সামগ্রী দিয়ে সূতির সুতোকে রাঙানোর কাজে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি।

তাঁর কাজ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত, এমনকি বিদেশেও বিভিন্ন মন্দির ও জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি তাঁর মর্যাদাপূর্ণ সৃষ্টির প্রদর্শনের জন্য ত্রিপুরা, দিল্লি, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও আসামে বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা, প্রদর্শনী, প্রশিক্ষণ ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেছেন। 

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: চেয়ারম্যান হলেন ৪ জন আদিবাসী প্রার্থী

উপজেলা চেয়ারম্যান আদিবাসী

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে চারজন আদিবাসী প্রার্থী চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। গতকাল বুধবার (৮ মে) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ করা হয়। ভোট গণনা শেষে রাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।

এতে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির সদর উপজেলা, বরকল উপজেলা, জুরাছড়ি উপজেলা এবং ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় চেয়ারম্যান হিসেবে আদিবাসী প্রার্থী বিজয়ী হন।  

রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দোয়াত কলম প্রতীকের অন্নসাধন চাকমা বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি সর্বমোট ভোট পেয়েছেন ১৪ হাজার ৮৮৫। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাডভোকেট বিপ্লব চাকমা উট প্রতীকে পেয়েছেন ১০ হাজার ২৯ ভোট।

বরকল উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন দোয়াত কলমের প্রার্থী বিধান চাকমা। তিনি পেয়েছেন ১১ হাজার ৩২৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা সন্তোষ কুমার চাকমা আনারস প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৬ হাজার ৬৭৭ ভোট।

জুরাছড়ি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা আনারস মার্কায় ৪ হাজার ৭৫২ ভোট পেয়ে বেসরকারীভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী সুরেশ চাকমা দোয়াত কলম মার্কায় পেয়েছেন ৩ হাজার ৪৩০ ভোট।

আনারস প্রতীক নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ধোবাউড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক ডেভিড রানা চিসিম। তিনি পেয়েছেন ২৮ হাজার ৬২৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আসাদুজ্জামান আকন্দ সাগর ঘোড়া প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২১ হাজার ৩৪৮ ভোট। 

‘শেরপুরে চিহ্নিত গোষ্ঠী আদিবাসীদের হামলা করে লুটপাট করছে’


বগুড়ার শেরপুরে কিছু চিহ্নিত গোষ্ঠী আদিবাসীদের উপর হামলা করে লুটপাট করছে। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। আদিবাসীদের জান মালের নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে শেরপুর উপজেলা আদিবাসী সমন্বয় কমিটি। আজ বুধবার সকালে পৌর শহরের পৌর শিশুপার্কে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ অভিযোগ জানায়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সমন্বয় কমিটির সভাপতি সন্তোষ সিং বাবু। তিনি বলেন, উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা আদিবাসীরা দেড়শ বছরের অধিক সময় ধরে বসবাস করছি। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কৃষি ও মজুর খেটে জীবিকা নির্বাহ করি। কিন্তু আপনারা লক্ষ্য করেছেন অনেক দিন ধরেই আমাদের উপর চিহ্নিত কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠী হামলা করে লুটপাট করছে।

২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত আদিবাসীদের ওপর ২০টির বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, আবাদি জমি ও পুকুর দখল, শ্মশান ও কালী মন্দির ভাঙচুর এবং শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুরুতর আহত করার ঘটনা ঘটেছে। এসব নিয়ে এ পর্যন্ত শেরপুর থানা-পুলিশের কাছে অন্তত ২০টি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু তিনটি অভিযোগ এজাহার হিসেবে গ্রহণ করলেও পুলিশ কাউকে আটক করেনি।

একই ব্যক্তিরা গত ৬ মার্চ আদিবাসী নেতা ও ভবানীপুরের ইউপি সদস্য সন্তোষ কুমার সরকারের বাড়িতে প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে হামলা চালিয়ে ৯ বিষা পুকুরের মাছ লুটে নেয়। এ সময় স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও দুই মাস ধরে তিনি ঘর ছাড়া। এর মধ্যেই গত ২ মে তার জমি থেকে সশস্ত্র অবস্থায় ধান কেটে নেওয়া হয়েছে। থানায় অভিযোগ দেওয়া হলেও কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমাদের অভিযোগ গুলোতে কয়েকজন ব্যক্তির নাম বার বার উল্লেখ করা হচ্ছে কিন্তু তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

সংবাদ সম্মেলন থেকে কয়েকটি দাবি জানানো হয়। দাবি সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আদিবাসীদের উপর হামলা ও সম্পদ লুটপাটকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার কর, আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মালা প্রত্যাহার কর, জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে, ২০১৮ সালের গঠিত তদন্ত কমিটির চিহ্নিত খাস জমি, পুকুর ও দেবত্তোর সম্পত্তি আদিবাসীদের বন্দোবস্ত দিতে হবে।

দাবি আদায়ের জন্য আগামী ১৩ মে সোমবার সকাল ১১ টায় শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে উপজেলার আদিবাসীরা। 

ব্যাঙের ছাতার মতো মান্দি ব্যান্ড দল জন্মাচ্ছে: টগর দ্রং

গারো শিল্পী

হার্টথ্রব সলো সিঙ্গার টগর দ্রং। শুরুতে বাংলায় গান করলেও স্বজাত্যবোধে গারো ভাষায় গান করেন। মিডিয়ার অন্তরালে থাকা প্রচার বিমুখ সদা হাস্যোজ্জ্বল দিলখোলা এই মানুষটি নিজ গন্ডির মধ্যে থাকতেই স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। জীবন যাপনে আছে যথেষ্ঠ পরিমিতি। বন্ধ পরিজন মহলে সুনাম আছে, তিনি বেশ আড্ডাবাজ। আড্ডায় যেকোন সময় অসময় নতুন কিছু বলে সঙ্গীদের চমকে দিতে পারেন। আচমকায় সবাই হো হো করে হেসে উঠেন।

প্রাইমারী পড়াকালীন সময় থেকেই গানের সঙ্গে সংসার তাঁর। স্কুল প্রতিযোগিতা, উপজেলা, জেলা, জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জিতেছেন পুরস্কার। পুরস্কারের কথা বলতেই ফাইল থেকে ৩১টি গানের সার্টিফিকেট বের করে দেখালেন। জানালেন, বাড়িতে আরো আছে অযত্নে অবহেলায়।

সম্প্রতি জনপ্রিয় এই শিল্পীর সাথে গারোদের গানের জগতে এগিয়ে চলা, ব্যান্ড দলগুলোর জন্ম মৃত্যু, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জনজাতির কন্ঠ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক উন্নয়ন ডি. শিরার সাথে আলাপ হল। আলাপে অকপটে জানালেন নিজের কথা, করলেন শিল্পী-ব্যান্ড দলগুলোর মান মূল্যায়ন।

জনজাতির কন্ঠ: কেমন আছেন?

টগর দ্রং: ভালো।

জনজাতি: ইদানিং মান্দি কমিউনিটির মধ্যে অনেকগুলো ব্যান্ড দল দেখতে পাচ্ছি। শিল্পীর দৃষ্টিতে বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

দ্রং: ব্যাঙের ছাতার মতো মান্দি ব্যান্ড দল জন্মাচ্ছে। এর নেগেটিভ পজেটিভ উভয় দিক আছে। অনেকে শখের বশে, দেখাদেখি থেকে আবার অনেকে প্রতিযোগিতা থেকে ব্যান্ড দল তৈরী করছে। গানের প্রয়োজনে ব্যান্ড দল তৈরী হচ্ছে না। দেখুন, সব প্রতিযোগিতা পজেটিভ ফলাফল বয়ে আনে না। আপনি যে কাজটা পারেন না বা করার দক্ষতা নেই, সেই কাজে লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

মান্দিদের অনেক ব্যান্ড দল আছে, যাদের ফাউন্ডেশন নাই। সঙ্গীত জগতে কাজ করতে হলে স্বরগম জানতে হবে। যা অনেকেই জানে না। অনেকে পুংতা গান গেয়েই বেশি পরিচিত। তাই বলে তাঁদেরকে প্রতিষ্ঠিত বলা যাবে না। মোল্লার দৌঁড় যেমন মসজিদ পর্যন্তই তাদের দৌঁড়ও ঐ পর্যন্তই।

জনজাতি: তারপরও অনেকে এগিয়ে যাচ্ছে..

দ্রং: হ্যাঁ। অনেকেই ভালো গাচ্ছে। এগিয়েও যাচ্ছে। তবে তাঁরা কতটুকু এগিয়ে যাবে সেখানে আমি সন্দিহান।

জনজাতি: আপনার গানের শুরুর গল্পটা..

দ্রং: প্রাইমারী পড়াকালীন সময়েই গান গাওয়া শুরু করি। বাবা একটি হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন। সাধের হারমোনিয়ামটি গণ ব্যবহারে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ছোটকালে ময়মনসিংহ হালুয়াঘাটে নজরুল সঙ্গীতে অপ্রতিরোধ্য ছিলাম। এমন দিন গেছে গাইলেই প্রথম হতাম! বাংলা গানোদে বাঙ্গাল রাঙবা আঙখোদে হামজা..(হাসি)। কিন্তু ত্রিশালে গাইতে এসে দ্বিতীয় তৃতীয় হতাম। ত্রিশালে সঙ্গীতের মান ভালো ছিলো।

জনজাতি: শুরুতে আপনি বাংলা গান গাইতেন। মান্দি গান গাওয়া শুরু করলেন কবে থেকে?

দ্রং: হ্যাঁ। আগে বাংলা গান (নজরুল ও রবীন্দ্র) গাইতাম। পরে নিজ জাতির লোকদের সাথে গভীর ভাবে মিশে মান্দি গান গাওয়া শুরু করি।

জনজাতি: মান্দি গান গাওয়ার শুরুর দিককার কথা শুনতে চাই..

দ্রং: ২০০৫/৬ সালের কথা। তখন আমি মান্দি অধ্যুষিত কালচাঁদপুরে আসি। এখানে এসে দেখতে পাই মান্দিরা নিজ ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষার জন্যে সংগ্রাম করছে। মান্দি ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি চর্চায় বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছে। এখানে এসে মান্দি গান গাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। এখানে আচিক স্কুল, আচিক পত্রিকা চলতো। অবলা পাথাং (আচিক স্কুলের কর্ণধার), অর্পন যেত্রা (আচিক পত্রিকার সম্পাদক), অনিত্য মানখিন, শুভজিৎ সাংমা (ঢাকা ওয়ানগালার সাবেক নকমা)-র মতোন অনেক সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়। এখানে এসেই উপলব্ধি করি কেন মান্দি গান গাবো না? জাতিত্ববোধ থেকেই মূলত মান্দি গান গাওয়া শুরু করি।

জনজাতি: এফ মাইনর নিয়ে আপনার মূল্যায়ন।

দ্রং: এফ মাইনর নিয়ে আমি আশাবাদী। কারণ তাঁরা সবাই শিক্ষানবিশ। অতি অল্প সময়ে তাঁরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বলা চলে তাঁরা এখন প্রতিষ্ঠিত। ব্যান্ডের ভোকাল পিংকি চিরান পড়াশুনা করছেন সঙ্গীত নিয়ে, কাজেই প্রত্যাশা অবশ্যই আছে। মিডিয়ার দিক থেকেও তাঁরা (এফ মাইনর) এগিয়ে আছে। প্রথম নারী ব্যান্ড দল বলেই কিনা সেই বিতর্কে যেতে চাই না।

জনজাতি: আপনি মূলত একক গান করেন। ব্যান্ড পার্টির এই যুগে কেন কোন ব্যান্ড দলে নন কিংবা যদি বলি কেন ব্যান্ড দল গড়ে তুলেননি?

দ্রং: সত্যি বলতে আমি আমার যুগোপযোগী পার্টনার পাইনি। কেবল ভালো ভোকাল, ভালো  ড্রামার, ভালো গিটারিস্ট মিলেই ব্যান্ড দল গঠন করা যায় না। সবার মাঝে ভালো বোঝাপড়া থাকাটা জরুরি। রাজনীতিতে যেমন আদর্শের মূল্য আছে, তেমনি ব্যান্ড দলেও আদর্শের যোগসূত্র থাকা জরুরি। আদর্শ ব্যতীত দল গঠিত হতে পারে না। হলেও ভেঙে যাবে। যেমন ‘রে রে’ (মান্দি ব্যান্ড) বারবার ভেঙে যাচ্ছে।

জনজাতি: প্রসঙ্গক্রমে ‘রে রে’ যেহেতু আলাপে উঠেই এল, তাদেরকে নিয়ে আপনার কী মূল্যায়ন?

দ্রং: ওদের উপর জনগণের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু তাঁরা যেভাবে এগোচ্ছে তাতে আমি আশার আলো দেখি না। তাদের নতুন গান আসছে, স্বাগত জানাই। তাদের লিরিকের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার বলে মনে করি। কারণ অনেক গান অমর হয় সুরে, আবার অনেক গান অমর হয় লিরিকে। লিরিক ও সুর দুটোতেই তাদের মনোযোগ দেয়া দরকার।

জনজাতি: ব্যান্ড দলে না থেকে একক ভাবে গাইছেন। শ্রোতা মহলে সাড়া কেমন?

দ্রং: একসময় ব্যান্ড দলের চেয়ে সলো সিঙ্গারদের চাহিদা বেশি ছিল। তখন ব্যান্ড দল ছিল কম। দিন বদলে গেছে। এখন সলো সিঙ্গাররা ভাত পায় না।

জনজাতি: মান্দি ব্যান্ড দলগুলোর মধ্যে কোন তিনটিকে এগিয়ে রাখবেন?

দ্রং: এফ মাইনর, সাক্রামেন্ট, রে রে। তবে জুমাং, ক্রেমলিন তাঁরাও ভালো করছে।

জনজাতি: আপনার বাল্যকালে দেখা মান্দি ব্যান্ড দল?

দ্রং: থাংস্রেক ব্যান্ড। তাঁরা মাইকে কনসার্ট করতো। তাদেরকে সাউন্ড সিস্টেম ছাড়াই মাইকে স্টেজ পারফর্ম করতে দেখেছি। এমনও হয়েছে ভোকাল একা মাইকে গান গেয়ে যাচ্ছে অন্যদের সাউন্ড কাভার হচ্ছে না! তবে ঐ সময়ে সমকালীন ইন্সট্র্রুমেন্টগুলো থাংস্রেক ব্যান্ড  ব্যবহার করতো। যা অবাক করার মতো।

জনজাতি: তিনটি প্রিয় মান্দি গান..

দ্রং: জন থুসিনের দিং দিং আপফাদে দিং, হাই সারি রি নামা, কবি মতেন্দ্র মানখিন লিখিত বাঙ জাবুছিম দুখনি সাগাল বালজ্র্রুয়ে। এই গানগুলো গারোদের অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে। এখনো দিয়ে যাচ্ছে। এই গানগুলো অমর।

জনজাতি: মান্দিদের মধ্যে গানে যাদু দা (যাদু রিছিল)-র নাম ডাক বেশ আছে। আপনার চোখে যাদু রিছিল..

দ্রং: (খানিকক্ষণ চুপ থেকে) যাদু ভালো কাজ করছে। এগিয়ে যাচ্ছে, আরো এগিয়ে যাক। তবে এজ অ্যা সলো সিঙ্গার স্টেজ পারফর্ম করতে হবে।

জনজাতি: আপনার অ্যালবাম সংখ্যা?

দ্রং: দুটি। মিক্সড অ্যালবাম। মাইখো চাইচিয়া, ঢাকা ওয়ানগালা স্পেশাল-২০১৮। সামনে একক অ্যালবাম করার ইচ্ছা আছে।

জনজাতি: একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন। পারিবারিক জীবনে আপনারা দুই ভাই, দুই বোন। আপনার বোনেরা এখনো সারি (গারো রীতিতে ভাইয়ের বউকে সারি বলে) থেকে বঞ্চিত..

দ্রং: (কথা শেষ করতে না দিয়েই) সারি তো এভেলেভেল (হাসি)।

জনজাতি: আপনার মূল্যবান সময় খরচ করে আলাপ পাড়ার জন্যে ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা।

দ্রং: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ছেঁটে দেওয়া চা গাছের মতোই জীবন

চা শ্রমিক

চা শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এই শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকদের জীবন যেন ছেঁটে দেওয়া চা গাছের মতোই। বঞ্চনা, বৈষম্যে কাটে তাদের নিত্য জীবন। সাধারণত চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকদের জীবন চা গাছের মতোই, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়ে ঘরে বন্দি। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাধা তার নিয়তি।

সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট বলছে, চা বাগান ও সংলগ্ন বস্তি এলাকায় বসবাসকারী নারী শ্রমিকদের জীবন কাটছে বঞ্চনা আর বৈষম্যে। অর্থ সংকটে অনেকেই ঝুঁকছেন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এর মাঝে বাগানে কাজ পাচ্ছেন না এমন নারী শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি। এ অবস্থার উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও তা এখনও বাস্তবে রূপ পায়নি।

চা বাগান এবং সংলগ্ন এলাকার বস্তিতে বসবাসকারী নারী শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি বিনোদন আর বিশ্রামের অধিকার থাকলেও তারা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। শ্রমিকদের অনেকের দাবি, চা গাছ ছেঁটে যেমন নির্ধারিত মাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

নারী শ্রমিকরা জানান, ঘুম থেকে উঠেই নাশতা সেরে কাজে বের হন আর বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যা নাগাদ। এরপর পরিবারের কাজে ব্যস্ত সময় কাটান। বাগানে যাদের কাজ নেই, তারা বিভিন্ন সাইটে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। কেউ কেউ আবার গাছ কাটাসহ অন্যের বাড়িতেও কাজ করেন। এভাবেই কাটে তাদের দিন।

বস্তির অতিদরিদ্র ও চা শিল্পে শ্রমজীবীদের মধ্যে এক বিরাট অংশ রয়েছে বেকার। তাদের মধ্যে যুবতী ও মধ্যবয়সী নারীও রয়েছেন। জীবিকার তাগিদে চা শিল্পের বাইরে কনস্ট্রাকশন, মাটি কাটা, মাথায় টুকরি নিয়ে ইট, বালু ও পাথর বহন করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত অনেকেই। তবে কঠিন কাজে নিয়োজিত থাকলেও মজুরি বৈষম্যের কারণে তাদের অবস্থার উন্নতি নেই।

শ্রমিকদের অভিযোগ, ঝড়ে ঘরের চালা উড়ে গেলে মালিকের অনুমতি ছাড়া মেরামত করা যায় না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ শ্রমিকরা অসহায়ত্ব আর উপোসে মৃত্যুর প্রহর গুনলেও নেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থা। প্রসূতি মায়েরা চিকিৎসার অভাবে, অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত অবস্থায় সন্তান জন্ম দেন। ওই কুঁড়েঘরটিই তাদের সন্তান প্রসবের স্থান।

তা ছাড়া বাগানের কিছু ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। চা বাগানে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা বর্তমানে দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক বেকার নারী শ্রমিক বস্তি কিংবা শহরের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন, মাটি কাটা, নার্সারি, কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।

মৌলভীবাজারসহ দেশের প্রায় ১৬৫টি চা বাগানের শ্রমিকদের চিত্র মোটামুটি একই। প্রায় ২০০ বছর ধরে মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানে বংশ পরম্পরায় কাজ করছেন চা শ্রমিকরা। তাদের শ্রমে এই শিল্পের উন্নয়ন হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা রাম ভজন কৈরী জানান, চা শ্রমিকরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ দেশে বাস করছেন। অনেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, তবে চা শ্রমিকরা আজও তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। মজুরি বোর্ড চা বাগানের শ্রমিকদের প্রতি অবিচার করছে। নারী শ্রমিকরা কর্মস্থলে উপযুক্ত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

 

তিতুমীর কলেজের আদিবাসী ছাত্র সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন (তালিকাসহ)

আদিবাসী ছাত্র সংগঠন
সভাপতি থুইচিং প্রু মারমা, সাধারণ সম্পাদক বিংশ দিব্রা (বাঁ দিক থেকে)

সরকারি তিতুমীর কলেজের আদিবাসী ছাত্র সংগঠন-এর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সোমবার (৬ মে), তৃতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে এ কমিটি গঠন করা হয়।

কাউন্সিলে আদিবাসী ছাত্র সংগঠনের সদ্য বিদায়ী সভাপতি মনিষা ম্রং ও সাধারণ সম্পাদক থুইচিংপ্রু মারমার সঞ্চালনায় অতিথি হিসেবে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।

অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী বাংলাদেশের আদিবাসীদের ইতিহাস তুলে ধরেন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সহ-সভাপতি যোহন দিও সংগঠনের ইতিহাস তুলে ধরেন। সাধারণ সম্পাদক থুইচিং প্রু মারমা বিগত কমিটির সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প তুলে ধরেন।

এছাড়াও সংগঠনটির উপদেষ্টা অভিভাবক কল্যাণ মারমা বক্তব্য রাখেন। তিনি সংগঠনকে একতার সাথে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত থাকার আহবান জানান।

তৃতীয় কাউন্সিলে সভাপতি হিসেবে থুইচিংপ্রু মারমা, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিংশ দিব্রা ও সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ইমেজ চাকমা নির্বাচিত হন।

পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা-


গঠিত কমিটির মেয়াদ এক বছর। 

 

সাজেকে গুলিবিদ্ধ সেই ত্রিপুরা শিশু মারা গেছে

ত্রিপুরা শিশু


রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ শিশু রোমিও ত্রিপুরা (৭) মারা গেছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম গন্ডছড়া এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলিতে রোমিও ত্রিপুরা তলপেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গত সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ২টায় সে মারা যায়।

রোমিও ত্রিপুরার বাবা ফবেন ত্রিপুরা মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেলে রাত ১১ টায় চিকিৎসকরা তাকে পিআইসিইউতে রেফার করে। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পিআইসিইউতে কোনো সিট খালি না থাকায় তাকে সেখানে থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ডেন্টাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসক লাইফ সাপোর্ট দিতে বলে। কিন্তু ডেন্টাল হাসপাতালে লাইফ সাপোর্ট না থাকায় সেখানে থেকে এশিয়ান হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই ছেলেটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিরীন আক্তার শিশু রোমিও ত্রিপুরার পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

 

মধুপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: একই পদে লড়ছেন দুই গারো নারী

যষ্ঠিনা নকরেক ও সন্ধ্যা সিমসাং (বাঁ দিক থেকে)। ছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের শালবন পরিবেষ্টিত মধুপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একই পদে লড়ছেন গারো জনগোষ্ঠীর দুইজন নারী। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দুইজন হলেন বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান যষ্ঠিনা নকরেক ও সন্ধ্যা সিমসাং। দুইজনেই মধুপুর গড় এলাকার বেরিবাইদ ইউনিয়নের বাসিন্দা।

একই পদে গারো জনগোষ্ঠীর দুইজন প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচন বেশ জমে উঠেছে। সেই সঙ্গে ভাগ হয়ে গেছেন ওই সব এলাকার ভোটাররা।

মধুপুর পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মধুপুর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে ৮ মে। উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ৫৫ হাজার ২১৮ জন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার আদিবাসী ভোটার রয়েছেন।

জানা গেছে, মধুপুর গড় এলাকার অরণখোলা, বেরিবাইদ, কুড়াগাছা, ফুলবাগচালা, শোলাকুড়া ও আউশনাড়া ইউনিয়নে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তাঁদের মধ্য থেকে দুজন প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচন জমে উঠেছে এসব এলাকায়। দুই প্রার্থীই নিজ জাতির ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনা ও সমর্থনের জন্য যাচ্ছেন। গারো জাতিগোষ্ঠীর ভোট দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

মধুপুর অঞ্চলের প্রবীন আদিবাসী নেতা অজয় এ মৃ বলেন, আদিবাসীদের মধ্য থেকে দুজন প্রার্থী হওয়ায় গারোদের ভোট ভাগ হয়ে যাচ্ছে, যা উভয় প্রার্থীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

এর আগে যষ্ঠিনা নকরেক ২০০৯ সালে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। সন্ধ্যা সিমসাং ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা যাওয়া গারো নেতা চলেশ রিছিলের স্ত্রী। তিনি প্রথমবারের মতো প্রজাপতি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। অন্যদিকে, যষ্টিনা নকরেক লড়ছেন ফুটবল প্রতীক নিয়ে।

 

সুস্থ জীবন পেতে চায় আদিবাসী যুবক লিংকন বাস্কে

আদিবাসী যুবক লিংকন বাস্কে। ছবি: সংগৃহীত

জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার আটাপুর ইউনিয়নের আংড়া গ্রামের আদিবাসী যুবক লিংকন বাস্কে। জন্মের পর থেকেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে এক চোখ হারায় সে। শুধু তাই নয়, কপাল ও চোখ জুড়ে বেরিয়েছে বিশাল একটি টিউমার।

লিংকনের বাবা দিনমজুর কর্নেলিউস বাস্কে জানান, জন্মের সময় আমার ছেলে ভালোই ছিল। দেড় বছর বয়সে বাম চোখে ঘা হয় তার।

চোখ দিয়ে সবসময় পানি পরত। চোখ ফুলে যায়। ব্যথা হওয়ার কারণে শিশু বয়সে লিংকন খুব কান্নাকাটি করত। এক মিশনারী ফাদার তার নিজের অর্থে ডাক্তারের পরামর্শে চোখ অপসারণ করান। পরবর্তীতে এক চোখ নিয়ে ভালোই ছিলো সে। কিন্ত ৪ বছর বয়সে ওই চোখের উপর ও কপালে ছোট-ছোট টিউমার বের হয়।

লিংকনের পরিবার জানায়, গ্রামের স্কুলে লিংকনকে ভর্তি করে দেওয়া হলেও টিউমার হওয়ায় লজ্জায় সে পড়ালেখা বন্ধ করে সর্বক্ষণ বাড়িতে শুয়ে বসে থাকত। টিউমারগুলো অপারেশনের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিলে ডাক্তার বলেন, অল্প বয়সে অপারেশন না করে বয়স বেশি হলে ভালো হবে।

এরপর ছেলের বয়স বেশি হলে ২০১৭ সালের দিকে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের খরচে ঢাকায় অপারেশনে টিউমারগুলো কেটে দেয়। কয়েকদিন পর আবার চোখের উপর কপাল জুড়ে টিউমার বের হয়। সংস্থাটির সহায়তায় একই হাসপাতালে পর পর ৪বার অপারেশন করা হয়। তবে ডাক্তার বলেছিলেন পঞ্চম বার অপারেশন করলে নতুন আর টিউমার বের হবে না। কিন্ত পঞ্চম বার অপারেশনের আগে পাঁচবিবি থেকে ওয়ার্ল্ড ভিশন অফিস বন্ধ করে দেয়।

এরপর টাকার অভাবে আর অপারেশন করানো হয়নি জানিয়ে লিংকন জানান, ছোটবেলা থেকেই কষ্টের জীবনযাপন কাটাচ্ছি। এমন অবস্থায় রোদে থাকতে পারি না। চোখ সর্বক্ষণ প্রচন্ড ব্যথা করে। বাবা-মা এখন বেঁচে আছেন। তারা খাওয়াচ্ছেন।

লিংকন বাস্কে আরো বলেন, সমাজের হৃদয়বান ব্যক্তিদের সহায়তায় আমি নতুন সুস্থ জীবন ফিরে পেতে চাই।

লিংকনের বাবার বিকাশ নম্বর ০১৭৫০-১২৫১৩৯ 

রাঙ্গামাটিতে আটক তিন ছাত্রনেতার মুক্তির দাবি পিসিপি’র


রাঙ্গামাটির জুরাছড়িতে সেনাসদস্য কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) তিন ছাত্রনেতাকে আটকের প্রতিবাদ ও দ্রুত নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। আজ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে পিসিপি এ দাবি জানায়।

পিসিপি’র তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অন্তর চাকমা প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৪ মে জুরাছড়ি উপজেলা সদরস্থ যক্ষা বাজার সেনাক্যাম্পের সেনাসদস্য কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের তিন ছাত্রনেতাকে অন্যায়ভাবে আটক করা হয়। এ ঘটনায় পিসিপি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং অবিলম্বে আটককৃত ছাত্রনেতাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানাচ্ছে।

পিসিপির জুরাছড়ি থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক রুপম চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক সুরেন চাকমা ও তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রনি চাকমা আসন্ন ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সুরেশ কুমার চাকমার নির্বাচনী প্রচারণার কার্যালয় থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন। এ সময় সেনা গোয়েন্দা রবিউল সুরেন চাকমার হাতে নিষিদ্ধ ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকানো একটি মানিব্যাগ দেয় এবং বলে সামনে আমাদের লোক আছে তার হাতে দিয়ে দিও।

তারপর কিছুদূর যেতে না যেতে সেনাবাহিনীর একটি দল জুরাছড়ি সদর এলাকার ধামাইপাড়া সেতু থেকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে তাকে যক্ষা বাজার সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর একই চেকপোস্ট থেকে নির্বাচন থেকে বাড়ি ফেরার পথে রূপম চাকমা ও রনি চাকমাকে আটক করে সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়।

পিসিপি’র অভিযোগ, সেনাসদস্যরা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ছাত্রনেতাদের ইয়াবা ট্যাবলেট ও চাঁদার রশিদ গুঁজে দিয়ে ছবি তুলে গতকাল জুরাছড়ি থানায় সোপর্দ করেছে। জুরাছড়ি থানা তাদের তিনজনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইন ও চাঁদাবাজির আইনে মামলা দিয়েছে।

সেনাবাহিনী কর্তৃক তিন ছাত্রনেতাকে অন্যায়ভাবে আটক ও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে পিসিপি তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে। একইসাথে আটককৃত তিন ছাত্রনেতার দ্রুত নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছে। 

কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে: পিসিপি

কল্পনা চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পিসিপি

পাহাড়ি নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণে দায়েরকৃত মামলা খারিজ করে চিহ্নিত অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)। আজ শনিবার (৪ মে), বিকাল ৫টায় ঢাকায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা এ কথা জানায়।

পিসিপির সভাপতি অঙ্কন চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সদস্য রূপসী চাকমা এবং সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. হারুনুর রশিদ, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নুজিয়া হাসিন রাসা।

‘অপরাধীদের দায়মুক্তির প্রহসনমূলক রায় মানি না, বাতিল কর দাবি সম্বলিত স্লোগানে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছর কালক্ষেপণ করে গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ রাঙামাটি জেলার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তার আদালত কল্পনা চাকমা অপহরণের মামলাটি খারিজ করে দেন। এ রায়ের মাধ্যমে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, নুরুল হক, সালেহ আহমেদ গংদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। প্রহসনমূলক এ রায় আমরা মানি না। আমরা এ রায় প্রত্যাখ্যান করছি। 

পিসিপির নেতারা আদালত কর্তৃক মামলা খারিজের যে আদেশ দেয়া হয়েছে অবিলম্বে তা বাতিল করে কল্পনা অপহরণ ঘটনার পুনঃতদন্ত ও চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানান।

এছাড়াও সমাবেশ থেকে বক্তারা মাইকেল চাকমাসহ গুম হওয়া সকল ব্যক্তিদের সন্ধানের দাবি জানান। 

‘কল্পনা চাকমার অপহরণ নিয়ে অনেকভাবে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে দুর্বৃত্তরা’

কল্পনা চাকমার অপহরণ নিয়ে বিভ্রান্তি

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার অপহরণ নিয়ে দুর্বৃত্তরা অনেকভাবে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। বাঙালিদের মতো পাহাড়িরাও অনেকে গুজব খেকো, বিভ্রান্ত হয়। অপহরণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে শাসকগোষ্ঠী নানা ষড়যন্ত্র করে। যারা চক্রান্তকারী এবং জনগণের শত্রু তারা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে নানাভাবে কাল্পনিক কাহিনী বানিয়ে মিথ্যাচার করে।

আজ শনিবার (৪ মে) কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা খারিজের প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি সদরে গণবিক্ষোভ ও বিচারের নামে প্রহসনে লিপ্ত কুচক্রীদের জুতাপেটা-কুশপুত্তলিকা দাহ কর্মসূচিতে পাহাড়ি নারী নেত্রীরা এসব কথা বলেন। পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত দুই নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ এ কর্মসূচি পালন করে।

সকাল ৯টার সময় খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজার এলাকা থেকে ৩০০ জনের অধিক একটি দল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে চেঙ্গী স্কয়ারে অবস্থান নেয়। একই সময়ে রাঙামাটি-মহালছড়ি-মানিকছড়ি-গুইমারা-রামগড়ের দিক থেকেও স্লোগান দিতে দিতে মিছিলকারীদের দল চেঙ্গী ব্রীজ দিয়ে সমাবেশস্থলে পৌঁছায়।

দীঘিনালা-সাজেক থেকেও প্রতিবাদী নারীদের মিছিল খাগড়াছড়ি প্রধান সড়ক দিয়ে চেঙ্গী স্কয়ারে এসে মিলিত হয়। সেখানে এক বড় সমাবেশে রূপ নেয়।

মিছিলকারীরা অপরাধীদের প্রতীকী হিসেবে কুশপুত্তলিকাও বহন করে আনে। মিছিল ও সমাবেশ থেকে ‘অপরাধীদের রক্ষার রায় মানি না’, ‘অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের বিচার চাই’, ‘বিচারের নামে প্রহসনে লিপ্ত কুচক্রীরা হুঁশিয়ার সাবধান’ স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রিতা চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন সংগঠটির কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা।

সভায় কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা নিয়ে প্রশাসনের গড়িমসিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। সমাবেশের এক পর্যায়ে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন বিচারের নামে প্রহসনে লিপ্ত কুচক্রীদের প্রতিকৃতিতে জুতা পেটা ও কুশপুত্তলিকা দাহ করে।

সভাপতির বক্তব্যে কণিকা দেওয়ান বলেন, বিচারের নামে প্রহসনের রায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তথা নারী সমাজ মেনে নেবে না। কল্পনা চাকমার অপহরণ মামলার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন।

সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা বলেন, ‘কল্পনা তো সাধারণ ছিলেন না। তিনি সংগ্রামী আদর্শে বিশ্বাসী এক রাজনৈতিক কর্মী। কেন তিনি প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাবেন? ষড়যন্ত্রকারীরা বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য এরকম গুজব রটায়। ফলে তাদের অপপ্রচারণায় আমাদের মধ্যেও দুর্বলচিত্ত কারোর কারোর দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল।’

নীতি চাকমা দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘কল্পনা অপহরণ মামলা যে খারিজ করে দেয়া হলো, এটি আমরা মানি না। কল্পনার সন্ধান করতে গিয়ে সমর-সুকেশ-মনোতোষ গুমের শিকার হয়েছে। রূপন আত্মাহুতি দিয়েছে; আমরা তাদের স্যালুট করি। যদি সাহসের সাথে আত্মবলিদানকারী কোনো সহযোদ্ধার নাম বলি, তাহলে প্রথম সারিতে রূপনের নাম আসবে ইতিহাসে। বীরত্বের সাথে বোনের সন্ধান করতে জীবন উৎসর্গ করেছে সে।

নারী নেত্রী নীতি চাকমা সরকারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমরা কোন দেশে বসবাস করছি, স্বাধীন দেশে বাড়িতে ঘুমাতে পারি না। ১৯৯৬ সালে ১২ জুনে নিজের বাড়িতে বিনা অনুমতিতে একজন ঘুমন্ত মানুষকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে অপহরণ করে, এখনও তার কোনো হদিস নেই। প্রশাসন এতো টালবাহানা করে যে, তাঁর ভাইয়েরা মামলা করতে গেলে সাধারণ জিডি নিতেও প্রশাসন নিতে চায়নি।’

সমাবেশ থেকে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাহাড় থেকে সেনা-সেটেলার প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। 

গ্রীষ্মের তাপদাহে পাহাড়ে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার

পাহাড়ে পানির অভাব

গ্রীষ্মের তাপদাহে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। অনাবৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ছড়াগুলো শুকিয়ে গেছে। পানির সংকটে হা-হুতাশ করছেন পার্বত্যবাসী।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের চিম্বুক সড়কের গেৎশিমানী বম পাড়ার বাসিন্দারা চার ফুটের মতো মাটি খুঁড়ে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। পাড়ার প্রায় ৮০টি পরিবার এ পানির উপর নির্ভরশীল। দৈনন্দিন নানা কাজের পাশাপাশি এ পানি পান করা হয়। একজনের পর আরেকজন সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করেন। কিন্তু এ পানি পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

তীব্র পানির সংকটে চিম্বুক পাহাড়ের কোরাং বাজার এলাকায় পানি বিতরণ করে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এ এলাকায় ম্রো জনজাতির ২১০টি পরিবারের বসবাস রয়েছে।

পানির জন্য হাহাকারের এ চিত্র কেবল বান্দরবানেই নয়। অনাবৃষ্টির ফলে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক ছড়া শুকিয়ে গেছে। উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের শিলছড়ি ছড়া, ভেলাপ্পা পাড়া ছড়া এবং ৩ নং চিৎমরম ইউনিয়ন ৩ নং ওয়ার্ডের জামাইছড়ি এলাকার ছড়াগুলো শুকিয়ে গেছে। ফলে সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন হাজারও এলাকাবাসী।

কিছু কিছু এলাকায় গভীর নলকুপ থাকলেও ছড়ায় পানি না থাকায় পানির স্তর নীচে নেমে গেছে। ফলে নলকূপেও পানি উঠছে না। এতে করে নদী হতে খাবার পানি এবং ব্যবহারের পানি সংগ্রহ করে এলাকাবাসীকে নিত্য প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি কাজ সারতে হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, সাধারণত মার্চ থেকে জুনের আগপর্যন্ত ছড়াগুলোতে পানি থাকে না; থাকলেও অল্প। তবে চলতি বছরের অবস্থা ভয়াবহ। দাবদাহে ছড়াগুলো পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। এতে পাহাড় সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পানির জন্য এই হাহাকার নিয়ে পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড়ে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়ের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। যার কারণে পানির উৎসও কমে গেছে। এ ছাড়া পাহাড় থেকে পাথর তোলা ও পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো ধ্বংস করায় দুর্গম এলাকাগুলোতে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। 

রাজশাহীতে বৃষ্টির আশায় আদিবাসী রীতিতে ব্যাঙের বিয়ে

ব্যাঙের বিয়ে, বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে

তীব্র তাপপ্রবাহে স্বস্তির বৃষ্টির আশায় আদিবাসী রীতিতে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২ মে) রাজশাহীর পবা উপজেলার ভুগরইল খ্রিস্টানপাড়ায় আদিবাসী রীতিতে ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন স্থানীয় আদিবাসীরা।

দুটি ব্যাঙের মধ্যে একটির নাম রাখা হয় শিমুল, আর অপরটির নাম মেঘলা। ব্যাঙের বিয়ের খবরে ভুগরইল আদিবাসী পল্লীতে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। শিমুল আর মেঘলার বিয়ে দেখতে ভিড় করেন গ্রামবাসী।

শিমুলকে সাজিয়ে-গুজিয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে-তালে নাচে গানে কনে মেঘলার বাড়িতে রওনা হয় গ্রামবাসী। ডনবক্স চার্চ থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে কনে পক্ষের বাড়ি। কনে মেঘলার বাড়িতে অতিথিদের নিয়ে বর শিমুল পৌঁছালে সেখানে বিয়ে পড়ানো হয় দুজনার। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় শিমুলের হাত দিয়ে মেঘলার কপালে সিঁদুর দিয়ে দেওয়া হয়।

গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে এ বিয়ের আয়োজন করেন অঞ্জলী বিশ্বাস। তিনি স্থানীয় ডনবক্স চার্চে শিশুদের শিক্ষাদান কর্মসূচির শিক্ষক এবং বর শিমুলের অভিভাবক।

অন্যদিকে, আদিবাসী পরিবারের অনার্স পড়ুয়া জয়া বিশ্বাস কনে পক্ষের অভিভাবক। তার বাড়িতেই বিয়ে পর্বের আয়োজন করা হয়।

বিয়ে শেষে শিমুল ও মেঘলাকে চার্চে নিয়ে এনে মাটির একটি গর্তে পানি দিয়ে তাতে আয়োজন করা হয় বর-কনের বাসরের। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ব্যাঙের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।

অঞ্জলি বিশ্বাস বলেন, ‘পুরো বিয়েটাই আয়োজন করা হয়েছে আদিবাসী রীতিতে। বৃষ্টির প্রয়োজন আছে। রোদ আর গরমে মানুষজন ও পশুপাখি থাকতে পারছে না। এজন্য আমরা চাচ্ছি যাতে অন্তত বৃষ্টিটা হয়।

অনাবৃষ্টি বা খরা দেখা দিলে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যুগ যুগ ধরে এভাবেই ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বৃষ্টির প্রত্যাশা করা হয়।  

প্রীতি ওরাং হত্যার বিচার বিশেষ আদালতে করার দাবি

প্রীতি ওরাং হত্যা, ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক

ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসার কাজে নিয়োজিত শিশু গৃহশ্রমিক প্রীতি উরাং হত্যার বিচার বিশেষ আদালতে করার দাবি জানানো হয়েছে।

আজ বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মহান মে দিবস উপলক্ষে জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন আয়োজিত এক গৃহশ্রমিক সমাবেশে সংগঠনের পক্ষে থেকে এ দাবি জানানো হয়।

সংগঠনের সভাপতি মমতাজ বেগমের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড আনিসুর রহমান মল্লিক, সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড আবুল হোসাইন, সংগঠনের উপদেষ্টা কমরেড মোস্তফা আলমগীর রতন, কমরেড জাকির হোসেন রাজু প্রমুখ।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, আজ মহান মে দিবস। আজ থেকে ১৩৮ বছর আগে আমেরিকার সিকাগো শহরে শ্রমিক নেতারা দাবি করেছিল ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা শিক্ষা ও বিনোদন। ১৩৮ বছর পরও বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকেরা ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের অধিকার থেকে বঞ্চিত। গৃহশ্রমিকরা সুরক্ষার মধ্যে না থাকার কারণে তারা নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যার শিকার হচ্ছে। এই শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য শ্রম আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প নাই।

নেতৃবৃন্দ গৃহশ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি জানান।

সমাবেশ শেষে একটি শোভাযাত্রা নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সংগঠনের কার্যালয়ে এসে শেষ হয়। 

‘দুই বছরের দুধের বাচ্চা কীভাবে কেএনএফ সন্ত্রাসী হয়’

কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ

বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) দমনের নামে যে যৌথ অভিযান চালানো হচ্ছে, এতে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। দুই বছরের দুধের বাচ্চা কীভাবে কেএনএফ সন্ত্রাসী হয়—প্রশ্ন তুলেছেন আদিবাসী ছাত্র-যুব নেতারা।

আজ বিকেলে ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে কেএনএফ দমনের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি বন্ধের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে তারা এমন কথা বলেন। আদিবাসী ছাত্র ও যুব সংগঠনসমূহের ব্যানারে এ মানববন্ধন হয়।

সভাপতির বক্তব্যে আন্তোনি রেমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে কেএনএফ-এর মতো সশস্ত্র সংগঠনের সৃষ্টি হতো না। শান্তিচুক্তির এতো বছরের অবহেলার কারনেই কেএনএফ-এর সৃষ্টি হয়েছে। কুচি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রধান নাথান বমকে গ্রেপ্তার করতে না পারার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে।   

আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অলিক মৃ বলেন, দোষ করেছেন একজন আর সেই দোষ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে গোটা জাতিগোষ্ঠীর উপর। কেএনএফ দমনের নামে একটা জাতিকে নির্মূল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছি বান্দরবানে।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মশিউর রহমান সংহতি জানিয়ে বলেন, ইরাকে প্রেসিডেন্ট বুশের সন্ত্রাস দমন আর বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস দমনের চরিত্র একই। সন্ত্রাস দমনের নামে যখন গোটা মুসলমানদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচিত করানো হয়, তখন বম জনগোষ্ঠীকেও সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সাধারণ বমদের গ্রেপ্তার করে কেএনএফ বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা অন্যায়।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ছাত্র-যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং বলেন, যারা সত্যিকারের অপরাধী তাদের খুঁজে বের করুন। অপরাধীদের শাস্তি হোক। সবাইকে এক পাল্লায় মাপা যাবে না।  

মানববন্ধনে আদিবাসী যুব ফোরাম, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, আদিবাসী যুব পরিষদ, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস), বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিলের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। 

রাষ্ট্র বনাম চেতনা

আদিবাসী জনগোষ্ঠী কারা


প্রিয় লেখক কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তার ‘পাহাড়ী জনপদে জীবনের অন্বেষা’ প্রবন্ধে লিখেছেন

‘‘কথা ছিল বাংলাদেশের ভাগে যে আকাশটুকু পড়েছে তার অধিকার সব মানুষের সমান থাকবে। থাকেনি।

কথা ছিল দেশের প্রধান জাতিসত্তার মানুষের পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকবে। থাকেনি।

কথা ছিল সামরিক বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে না পাহাড়ী মানুষের জীবন। হয়নি।

কথা ছিল একটি শান্তি চুক্তির সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়ে পরিপূর্ণ শান্তি আনা হবে বিদ্রোহী জনপদের অশান্ত মানুষের হৃদয়ে। হয়নি।

কথা ছিল সব নৈরাজ্যের অবসান শেষে পাহাড়ী আদিবাসীদের মর্যাদা সমুন্নত হবে। হয়নি।’’

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার আইএলও কনভেশন নং-১০৭ র‌্যাটিফাই করেন। এই কনভেনশনে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমির মালিকানা ও অধিকার স্বীকৃত। দুঃখের বিষয়, এই কনভেশনের আলোকে এখনো এই রাষ্ট্র সরকার কনভেনশন বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কনভেনশনে বলা আছে, আদিবাসীদের কাগজ ও দলিল থাকুক বা না থাকুক যে জমি তারা ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করে আসছে সে জমির অধিকার তাদের, মালিকানা তাদের। বঙ্গবন্ধুর পর বাকি সরকারগুলো বাকি কাজগুলো আর করেনি। মুদি দোকানির মতো বাকি রেখে দিয়েছেন।

১৯৬২ সালের তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে ৮ ফুট উঁচু কাঁটাতাঁরের বেড়া নির্মাণ করেছিলেন ৬০ কি.মি মধুপুরের শালবনে। ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সৈনিক এম এল প্রশান্ত তার ফিরে দেখা নামক লেখায় জানিয়েছেন, ‘মধুপুরে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের কাজ ২০০২ থেকেই শুরু করে বনবিভাগ। রসুলপুর থেকে মাপ যোগ করে আদিবাসী গ্রাম সাঁতারিয়া পর্যন্ত যখন পৌঁছে তখন স্থানীয় জনগণ বাধা প্রদান করে। এতে নেতৃত্ব দেন যতীশ দফো, ইলিপ চাম্বুগং, মার্থা চাম্বুগংসহ আরো কয়েকজন। এপ্রিলের ২০০৩ সালে আবার দেয়াল নির্মাণ কাজ শুরু করেন এইসব পয়েন্টগুলোতেরসুলপুর, সাতারিয়া, জালাবাদা, সাধুপাড়া, কাকড়াগুনি, লোহরিয়া, ধলিবাইদ বাদরবাগ।’

আবিমার সকল সংগঠন নিজেদের অস্তিত্ব ভূমি রক্ষার জন্যে সংঘবদ্ধ হতে থাকে এবং মিছিল মিটিং মানববন্ধন শুরু করে। অপর দিকে বনবিভাগ শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সপ্তাহব্যাপী সকল এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলিত হয়। কালো পতাকা উত্তোলন করে ০৩/০১/২০০৪ তারিখ শান্তিপূর্ণ মৌন মিছিল বের হয়। সাধুপাড়া জালাবাদা হয়ে গায়রা স্কুলে হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম, সমাবেশ হয়। সমাবেশ শেষের মিছিল রাজঘাট নামক স্থানে পৌঁছালে বিনা প্ররোচনায় বনরক্ষক ও পুলিশ মিলিত প্রয়াসে বিনা উস্কানিতে গুলি বর্ষণ করে। ঘটনাস্থলেই মারা যান শহীদ পিরেন স্নাল, চির পঙ্গুত্ব বরণ করেন গারো যুবক বীর উৎপল নকরেক। এসময় অর্ধ-শতাধিক গুলিবিদ্ধ হন। স্বাধীন রাষ্ট্রের এমন বর্বর নৃশংস আচরণ ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ। এটি মহান ৭১-এর চেতনার পরিপন্থী।

ইতিহাস নাড়াচাড়া করে আমরা দেখতে পাই, অতীতে আদিবাসীদের একের পর এক মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। বর্তমানে আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে জমি ভূমি, বসতভিটা। হরণ করা হয়েছে আদিবাসীদের সরকারী চাকুরিতে প্রবেশের কোটা পদ্ধতি। আদিবাসী বান্ধব সরকার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ সরকার আদিবাসীদের নিয়ে রাজনীতির গুটি নাড়ছে।

আদিবাসী অধ্যুষিত মধুপুর শালবনের দোখলায় বাংলাদেশের সংবিধানের প্রাথমিক খসড়া রচিত হয়েছিল। কত যন্ত্রণায় প্রাপ্ত সেই সংবিধানে ঠাঁই হয়নি মধুপুরে অবস্থিত গারো তথা সমগ্র আদিবাসীর আত্মপরিচয় এবং ভূমির অধিকার। এই রাষ্ট্রের বর্তমান ৭১-এর চেতনা নামক ফুলের স্ফুলিঙ্গ ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে একাত্তরের প্রকৃত আদর্শধারীরা। একাত্তরের চেতনা কি এই ছিল যে, ধর্ম ব্যক্তি পর্যায় পেরিয়ে রাষ্ট্র ধর্মান্তরিত হোক? রাষ্ট্রের ধর্ম হোক একটা গোষ্ঠীর! আজ অসাম্প্রদায়িকতা কোথায়? আমি খুঁজে বেড়াই।

রাষ্ট্রকে ধর্মান্তরিত করার এমন আচরণে অনেক মুক্তিযোদ্ধা চুপ ছিলেন। মৌন ছিলেন তথাকথিত আদিবাসী সরকারি নেতারাও। আবার আদর্শিক গুটি কয়েক মুক্তিযোদ্ধারা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ধর্মের জন্যে আমরা অস্ত্র নিয়ে দেশ স্বাধীন করিনি। এখানে গান্ধীজীর একটা কথা স্বরণযোগ্য, ‘‘কোন দেশ কতটা সভ্য, তা বোঝার একটা পথ হলো সে দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থান দেখা, তারা কতটুকু নাগরিক অধিকার ভোগ করে তার পরিমান জানা।’’ গান্ধীর এই উক্তির মাপকাঠিতে পরিস্কার দেখা যায় এই রাষ্ট্রের প্রকৃত চেহারা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানা জুড়ে স্বাধীনতার সুবাতাস বইলেও আদিবাসীদের গায়ে সেই বাতাস লাগে না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, আদিবাসী অধিকারের জন্য যে লড়াই তা গারো বা মারমা ত্রিপুরা চাকমাদের একার নয়, এটা সমগ্র জাতির সামষ্টিক লড়াই। রাষ্ট্র যতো এই উপলব্ধি করবে ততোই সে উন্নত হবে।

এদেশে যুগ যুগ ধরে আদিবাসীরা বৈষম্য বঞ্চনার শিকার। বঞ্চনায় গ্রাস করা হয়েছে আদিবাসীদের অস্তিত্ব। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রত্যেক সরকারই তাদের সুবিধা মতোন আদিবাসীদের ব্যবহার করেছে। নির্বাচন আসলে একগাদা ইশতেহার দিয়ে বাদঁর নাচা নাঁচায়, বাস্তবে অধিকার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ ছিঁটেফোটাও নেই। পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হলে কোনো জাতিগোষ্ঠীকে অবহেলা বা তুচ্ছ জ্ঞান করে রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারবে না। সবাই এগিয়ে গেলেই রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে এগোতে হলে আদিবাসী সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। এটি ভাবনার বিষয়।

বাঙালি পাকিস্তানের জাতি-ভাষাগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার অর্জন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই বাঙালিই আদিবাসীদের ওপর একই নিপীড়ন চালাচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা কলুষিত।

মহান সংবিধানকে এই সত্য মানতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্মের বৈচিত্র্যপ‚র্ণ দেশ। সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তা বিশিষ্ট বাঙালি জাতির মতো মিথ্যা কলুষিত অসত্য বাক্য। এর বিপরীতে বলতে হয়, বাংলাদেশ কোনো একক ভাষা, একক জাতির রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আরও জাতির মানুষ বসবাস করে, তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা আছে এবং সে ভাষায় তারা কথা বলে। সংশোধিত সংবিধানে দেশের অন্য ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষাকে পরিত্যাজ্য করা হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে এক ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করে আঘাত করা হয়েছে দেশের বহু মাত্রিক বৈচিত্র্যকে। মাতৃভাষার জন্যে যারা রক্ত দিয়েছে তাদের কাছেও অন্য মাতৃভাষা নিরাপদ নয়। বিষয়টা ভাবতেই কষ্ট লাগে। এ লজ্জা কার? এদেশের বর্তমান রীতিনীতি এদেশের ম‚ল চেতনারই পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেশে দুর্নীতিই এখন নীতি। রাষ্ট্র বনাম চেতনা সাংঘর্ষিক।

লেখা শেষ করতে চাই প্রিয় কবি লেখক রফিক আজাদের কবিতা দিয়ে। ১৯৭৬ সালের মে মাসে রফিক আজাদ রচনা করেছিলেন মধুপুরের শালবনের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবিতাটি

‘‘স্পর্শকাতর এই নাম

উচ্চারণ মাত্র যেন ভেঙে যাবে,

অন্তর্হিত হবে তার মহিমা-

চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে ভেতরে

খুব শক্তিশালী

মরণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।

মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।

চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্ত স্নিগ্ধ পূর্নিমার চাঁদ।

চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি।

চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।

চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।’’

কবির সময়ের উপলব্ধি, তিনি হিংস্রতা দেখেনি! কবি কি জানে বর্তমানে কত হিংস্রতায় ভরা চুনিয়া? ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার জাতীয় উদ্যান গড়েছিল গারো কোচদের ভূমিতে। কাগজে কলমে এর লক্ষ্য উদ্দেশ্যে ছিল বন সংরক্ষণ উন্নয়ন। বাস্তবে ছিল গারো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা এবং তা কার্যসিদ্ধির জন্য পাকিস্তান সরকারের পর এই স্বাধীন বাংলার সরকার ২০০৪ সালে যে বর্বরতা দেখিয়েছে তা এক ভয়ানক হিংস্র রূপ। এজন্যেই আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং আক্ষেপে বলেছেন, ‘মধুপুর জাতীয় পার্ক এখন বাইরের আমোদ প্রিয় লোকদের বনভোজন ও আনন্দ ভ্রমণের জন্যে উপযুক্ত জায়গা, আদিবাসীদের জন্য অনুপযুক্ত। বনের আদি অধিবাসী গারো, কোচদের জীবন হুমকিতে।’

লেখক: নিগূঢ় ম্রং, কবি ও লেখক। 

© all rights reserved - Janajatir Kantho