সাজেকের দুর্গম গ্রামগুলোতে প্রতি বছর খাদ্যাভাব দেখা
দেয়। সীমানাঘেঁষা ২০-২৫টি গ্রামের প্রায় চার শত মানুষ বছরের একটা সময় ভাতের অভাবে জঙ্গলের
আলু, ফল খাবার সংগ্রহ করে খায়। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে এক অন্যরকম বিসদৃশ্য চিত্র দেখা
যায়।
এখন বান্দরবানে আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্ট হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বীর বাহাদুর এমপি বলেছিলেন, ‘‘বান্দরবানে এক ইঞ্চিও খালি
জায়গা রাখা হবে না, উন্নয়নের জোয়ারে ভাসবে পার্বত্য এ (বান্দরবান) জেলা।’’
সরকার ও সেনাবাহিনীর একমাত্র এজেন্ডা যেন আদিবাসীদের
উন্নয়ন। তারা গণমাধ্যমে একদিকে জোরে উন্নয়নের ঢাক বাজাতে থাকেন, অন্যদিকে আদিবাসী প্রান্তজন
চলে যান রাষ্ট্রীয় প্রান্তের ওপারে। পাহাড়িরা যখন দলে দলে ক্ষুধা আর দারিদ্রে জেরবার
হয়ে দেশান্তরি হন তখন সরকারের বাজানো উন্নয়নের ঢাক উপহাসের সুরে বাজতে থাকে।
সরকারের এমনই উন্নয়ন যে উন্নয়নের উৎপীড়নে পাহাড়িদের
দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। গত বছর এভাবে মিয়ানমারে পালাতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে একজন ম্রো
আদিবাসী মারা গিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে ‘একাত্তর টিভি’তে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে দেখানো
হয়েছে যে, খাদ্য সংকটের কারণে গত তিন বছরে শতাধিক পরিবারের প্রায় পাঁচশ আদিবাসী দেশ
ছেড়ে গেছেন।
লেখক এবং সমাজকর্মী কংচাই মারমা ২০১৮ সালের মার্চ
মাসে এক ফেসবুক নোটে দেশত্যাগী ম্রো আদিবাসীদের কথা তুলে ধরেছেন। সব ক্ষেত্রেই দেখা
গেছে খাদ্যাভাব, জীবিকার সংকট, জীবনযাপনের সংকটে তাঁরা দেশ ত্যাগ করেছেন। বোমা নয়,
গুলি নয়, উন্নয়ন! উন্নয়নের উৎপীড়নে তাঁরা দেশ ছাড়ছেন।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি’তে প্রচারিত
এক প্রতিবেদনে সাজেক পর্যটন এলাকার গ্রামপ্রধান অনিশ্চিত, ভয়ংকর এক ভবিষ্যতের আশঙ্কার
কথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘আগে যেখানে ১২০ পরিবার পাংখো, লুসাই জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিলো
এখন সেখানে আছে মাত্র ১০ পরিবার। সামনের দিনে টিকতে পারবো কিনা বলা যায় না।”
প্রতিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়ন আধুনিকায়নের ফলে পাহাড়ি
আদিবাসীদের জীবনযাপন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হওয়ায় পাহাড়িরা ভিটেমাটি ছাড়ছেন। লেখক
গবেষক হাবিবুর রহমান প্রতিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়নকে পাহাড়িদের খাদ্যাভাব ও দেশত্যাগের
জন্য দায়ী করেছেন। বাণিজ্যিক বৃক্ষায়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ব্যাহত
হয়। রাবার গাছ, সেগুন গাছের মতো বাণিজ্যিক বৃক্ষায়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়।
একটা প্রাকৃতিক বনের মাটির উপরে থাকা কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে মাটির অনুজীব সকলেই প্রাকৃতিক
পরিবেশ রক্ষা করে। পাহাড়িদের জুম চাষ সম্পূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর চাষাবাদ পদ্ধতি। ফুলের
পরাগায়ণ থেকে শুরু করে ঝড়-বৃষ্টি-রোদ, তার সবকিছুই প্রকৃতি নির্ভর। সারা দেশেই জলবায়ু
পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কৃষিজ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। তাই জুম চাষের ভবিষ্যত একেবারেই
অনিশ্চিত। রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শন মূলত রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণি ও সংখ্যালঘু জাতিরই উন্নয়ন
দর্শন। সেই দর্শন দুর্গম আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দর্শন নয়।
‘ঝগড়াপুর: পুওর পিজ্যান্টস অ্যান্ড উইমেন ইন এ ভিলেজ
ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ের লেখক সমাজবিজ্ঞানী ইয়েনেকে আরেন্স পার্বত্য চট্টগ্রামের
উন্নয়নের রাজনীতি নিয়ে ‘উইনিং হার্টস অ্যান্ড মাইন্ডস: ফরেন এইড অ্যান্ড মিলিটারাইজেশন
ইন দ্য চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন,
‘‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের পেছনে যে উন্নয়নের রাজনীতি আছে তা সাধারণত চাক্ষুষ
আলোচনায় আসে না। আরেন্স-এর রচনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্নয়ন রাজনীতি,
উন্নয়নের রেটরিক ও জাতীয়তার ন্যারেটিভের সম্পর্ক উন্মোচন করে। সত্তর-আশির দশকে পাহাড়িদের
বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের গণহত্যা আর বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে বিদেশি ত্রাণের টাকা দিয়ে। পার্বত্য
চট্টগ্রামকে উন্নত করতে যে বিদেশি ত্রাণ এসেছিলো, তা ব্যয় হয়েছে পাহাড়ের সামরিকায়ন
আর সামরিক উদ্দেশ্যে নির্মিত অবকাঠামো নির্মাণে। সামরিক রণনীতি অনুযায়ীই এইসব অবকাঠামো
নির্মাণ হয়েছে।’’
দুস্তর পাহাড়, বন ভেদ করে যে রাস্তা চলে দুর্গম পাহাড়ি
জনপদে- সেই রাস্তা দিয়েই গেছে সামরিক বাহিনীর কনভয় এবং বাঙালি সেটলারদের ট্রাক। এই
রাস্তা দিয়েই বাংলাদেশের পুঁজিবাদী শোষণের রাস্তা খুলে দেয়া হয়েছে। আদিবাসী অধ্যুষিত
দুর্গম এলাকা উন্নয়নের নামে সমুদয় বৈদেশিক ডলার আদিবাসীদের কোনো কাজেই আসেনি, তা কাজে
লেগেছে সেনাবাহিনীর ইনসার্জেন্সি দমন করতে, আদিবাসী অর্থনীতি ধ্বংস করতে আর বাজার অর্থনীতির
কালো হাত সম্প্রসারণ করতে। কাউন্টার ইনসার্জেন্সির অন্যতম কৌশল হচ্ছে পেসিফিকেশন বা
শান্তকরণ, অর্থাৎ ‘শত্রুর মন ও হৃদয় জয় করা’, মানে শান্তির-স¤প্রীতির ধোঁকা-ছলনা। পাহাড়ের
আনাচে কানাচে সেনাবাহিনীর বানানো সব মন জয় করা প্রকল্পগুলো ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছু নয়।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রিজ-কালভার্ট-রাস্তা বানানোর উদ্দেশ্য, সেই রাস্তা দিয়ে তাদের সৈন্য
ও রসদ পৌঁছানো। স্কুল, মন্দির বানানোর উদ্দেশ্য এলাকার মানুষের মন জয় করা। কমিউনিটির
ভিত্তিতে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বানানো- অর্থাৎ, মারমা, ত্রিপুরা, বম, ম্রো ইত্যাদি
জাতিগতভাবে শ্রেণিকরণ করে উন্নয়নের পয়সা বিতরণের উদ্দেশ্য জাতিগতভাবে আদিবাসীদের ভাগ
করা আর শাসন করা। তাই সাদা চোখে যাকে শান্তি-সম্প্রীতি-উন্নয়ন মনে হয়, তার পেছনে দমন-পীড়ন-শোষণের
ষড়যন্ত্র রয়েছে।
রাষ্ট্রের এই উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতিকে উন্মোচিত করা
প্রত্যেক দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবির কর্তব্য। রাষ্ট্রের উন্নয়ন রাজনীতির স্থানিক-কালিক
ও বহুমাত্রিক রূপভেদ উন্মোচন এই ছোট লেখায় ধারণ করা সম্ভব না। কীভাবে সরকারি কালো পিচের
রাস্তা দুর্গম বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে সেখানকার আদিবাসীদের শোষণ করে, কীভাবে আদিবাসী
অর্থনীতিকে বাজার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা হয়, কীভাবে পর্যটন আদিবাসীদের শোষণ করছে-
এর একেকটি বিষয় নিয়েই বিস্তৃত গবেষণা হতে পারে।
এই লেখায় আমি উন্নয়ন আগ্রাসনের সাথে রাষ্ট্রের চলমান
উন্নয়ন রাজনীতি এবং পর্যটনের সম্পর্ক সংক্ষেপে তুলে ধরবো। লেখার শুরুতে বলেছিলাম, রাষ্ট্রের
উন্নয়ন দর্শন অনুযায়ী গৃহীত নীতিমালা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়নের ফলে আদিবাসীদের প্রান্তিকীকরণ
হচ্ছে। এসব নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রান্তিক আদিবাসীদের নূন্যতম অংশগ্রহণ নেই।
যেমন সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’
প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনের ৯ (ড) ধারায়, কালচারাল ট্যুরিজম ডেভেলপ করার জন্য বলা হয়েছে।
গবেষক পাভেল পার্থ ‘আদিবাসী সংস্কৃতি মানে পর্যটন ব্যবসা?’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘ক্ষুদ্র
নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনটি পাঠে মনে হয় আদিবাসী জনগণের জীবন সংস্কৃতি কেবল
জাদুঘর, মঞ্চ বিনোদন আর পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্যই।
প্রতিবছর পার্বত্য এলাকায় লোক শিল্পমেলা থেকে শুরু
করে আদিবাসী সংস্কৃতি রক্ষা ও প্রদর্শনীর বহর দেখে মনে হয় আদিবাসী সংস্কৃতি যেন সংখ্যাগুরুর
কাছে বিক্রয়যোগ্য পণ্যের পসরা। এই আইনে আদিবাসী সংস্কৃতির বিকাশ ও বাজারজাত করার বিধান
থাকলেও তা রক্ষার কোনো কথা নেই। বিকৃতি ও চুরি থেকে আদিবাসীদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-জ্ঞান
রক্ষার বিধি-বিধান নেই। বাজারমুখীনতাই আদিবাসী সংস্কৃতি চর্চার শেষ কথা। সংস্কৃতির
এই বাজারজাতকরণ বা কালচারাল ট্যুরিজম ও এথনিক ট্যুরিজম আদিবাসী জনপদে ইতোমধ্যেই বিরূপ
প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।’’
প্রাবন্ধিক ও গবেষক আলতাফ পারভেজের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম:
কারও বিনোদন কারও হুতাশন’ শীর্ষক লেখায়ও পর্যটনের কুফল কিছুটা প্রকাশ পেয়েছে।
রাষ্ট্রের উন্নয়ন পলিসি, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অনেক
সময় আদিবাসীদের প্রান্তকিকরণ ঘটায়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে আদিবাসীদের গৃহহীন
হওয়া, আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার সংকট ঘটা পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন নয়। কেবল কাপ্তাই
বাঁধের ফলেই ষাট হাজার পাহাড়ি গৃহহীন হয়েছিলেন।
কাউন্টার ইনসার্জেন্সির পরিকল্পনা অনুযায়ী জিয়াউর
রহমানের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়েছিল। উন্নয়ন বোর্ডের রাবার বাগান
প্রকল্প, কৃষিজ উৎপাদনের বাণিজ্যিকীকরণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ
ধ্বংস হয়ে গেছে। কাপ্তাই বাঁধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট- সবই
রাষ্ট্রের উন্নয়ন আগ্রাসনের দৃষ্টান্ত।
এই লেখার শুরুতে যেসব অনাহারী আদিবাসীর কথা আমি বলেছি-
এরা সবাই উন্নয়ন আগ্রাসনের শিকার। একদিকে তাঁদের খাদ্য সংস্থানের উৎস যেমন ধ্বংস হয়েছে,
অন্যদিকে তাঁদের আদিবাসী অর্থনীতি ধ্বংস করে বাজার অর্থনীতি নির্ভর করা হয়েছে। ফলে
এসব মানুষদের খাদ্যের জন্য বাজারমুখী হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আদিবাসীদের অর্থনীতি সম্পূর্ণ
বাজার নির্ভর নয়। আদিবাসী অর্থনীতি মূলত সাবজিস্টেন্স ইকোনমি, মার্কেট ইকোনমি নয়। সমতলের
একজন চাষী পটল চাষ করেন বা মূলা চাষ করেন সবটা বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহের
জন্য। জুমচাষী পাহাড়িরা জুম চাষ করেন বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে নয়, বরং তা করেন পরিবারের
ভরণপোষণের জন্য।
পাহাড়ের প্রতিটা বাজার আদিবাসীরা নয়, বাঙালিরা নিয়ন্ত্রণ
করেন। কাঁচা বাজারের ফড়িয়া-বেপারি থেকে শুরু করে পরিবহণ পর্যন্ত। আশির দশকে যে চার
লাখ সেটলার বাঙালি নিয়ে আসা হয়েছে, তাঁরা বাজার অর্থনীতির প্রতিনিধি। তাঁরা পাহাড়ে
আসার সময় বাজার অর্থব্যবস্থাকে নিয়ে এসেছেন আর তাকে পাহাড়ের কোনায় কোনায় নিয়ে গেছেন।
‘‘এগ্রেসন অফ ‘ডেভেলপমেন্ট’ অ্যান্ড স্ট্রাগল ফর আইডেন্টিটি:
দ্য কেস অফ ন্যাশনাল মাইনরিটিস ইন দ্য সিএইচটি, বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রবন্ধে অধ্যাপক
আনু মুহাম্মদ উপরোক্ত পরিস্থিতির ঐতিহাসিকতা ব্যাখ্যা করেছেন। আজও আমরা পাহাড়িদের উন্নয়নের
মূলধারায় নিয়ে আসার কথা শুনতে পাই। উন্নয়নের মূলধারা মানে দুর্গম পাহাড়ের কোনায় পড়ে
থাকা বস্তুটাকে জাতীয় বাজারের পণ্য বানিয়ে নিয়ে আসা। পুঁজিবাদী উন্নয়ন মানে রাস্তা,
ব্রিজের মতো উপরিকাঠামোর উন্নয়ন, বাজারব্যবস্থার চ্যানেল স্থাপন, যাতে করে সহজে পণ্য
পরিচালনা সম্ভব হয়। বাজার বসলে কেউ ক্রেতা হবে, কেউ পণ্য আর কেউ বিক্রেতা। পর্যটনের
ফলে যে বেচাকেনা হবে- সেখানে পাহাড়িদের সবকিছুই বিক্রি হবে। পাহাড়ি সংস্কৃতি থেকে শুরু
করে যৌনতা। যেহেতু পাহাড়িদের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেই, এই বাজারে পাহাড়িদের পণ্য
হওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। সুতরাং এই বাজার ব্যবস্থা হবে নয়া শোষণ-নিপীড়নের কৌশল।
তাই এই উন্নয়ন আগ্রাসন বা ডেভেলপমেন্ট এগ্রেসনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সিস্টেমেটিক মার্জিনালাইজেশন।
গোটা পর্যটনের প্রসারে পার্বত্য চট্টগ্রামটাই ট্যুরিজম
ইন্ডাস্ট্রির একটা কেন্দ্র হয়ে যাচ্ছে। দুর্গম বনাঞ্চল, আদিবাসী হয়ে যাচ্ছে বেচাকেনার
হাট। পর্যটকেরা ভোগ্য পণ্যের মতোই ভোগ করছে আদিবাসীদের প্রতিদিনের জীবনযাপন যেন মানব
চিড়িয়াখানা!
সাংস্কৃতিক-নৈতিক-মানবিক মূল্যবোধের ত্বরিত অবক্ষয়
ঠেকানো যাচ্ছে না। ঘরের মেয়ে বাজারের মেয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাজারে বেচার জন্য বাগানের কাঁঠালের
চাইতে নিশ্চয় নারীদেহের দাম বেশি।
লেখার শুরুতেই আমি দেখিয়েছি, পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের
ফলে মানুষের জীবনমানের কোনো উন্নয়ন হয়নি। মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন না করে, পরিবেশ-প্রতিবেশ
ধ্বংস করে, সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধ্বংস করে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন যজ্ঞের
সর্বাত্মক বিরোধিতা করা এখন সময়ের দাবি। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রের কায়েমী মহলের
চক্রান্তে খাগড়াছড়িতে বিশেষ পর্যটন জোন গড়ার প্রক্রিয়া গণ-আন্দোলনের মুখে ভেস্তে যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন করতে কি শুধু পর্যটনই একমাত্র উপায়? আর কিছু নয়? প্রতি
বছর বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাস, বাংলায় যাকে মধু মাস বলা হয়, সেই সময়ে খাগড়াছড়ির রাস্তায় উপচে
পড়া ফল পচঁতে থাকে কেবলমাত্র একটি হিমাগারের অভাবে। দরিদ্র জুমচাষী ফসলের দাম পায় না।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কৃষিশিল্পের বিকাশ না করে, মানুষের জান মালের নিরাপত্তা
নিশ্চিত না করে কেন পর্যটন শিল্পই বিকাশ করতে হবে? আর কোনো শিল্প কি গড়ে উঠতে পারে
না সেখানে? কেন এলাকার শিল্প সম্ভাবনা যাচাই না করে হুট করে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় খাগড়াছড়িতে
বিশেষ পর্যটন গড়তে গেল সরকার?
এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের রাষ্ট্রচরিত্র,
রাষ্ট্রের উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতি বা ‘পলিটিক্স অফ ডেভেলপমেন্ট’ নিয়ে জোর আলোচনা হওয়া
দরকার। পর্যটন নামের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ দরকার।
২০১৬ সালে যেভাবে গণজোয়ার বিশেষ পর্যটন অঞ্চল রুখেছে, সেভাবে রুখে দিতে হবে উন্নয়ন
আগ্রাসন।
লেখক: পাইচিংমং মারমা, ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন