যে চিম্বুক পাহাড়কে নিয়ে ম্রো আদিবাসীদের অনেক গল্প-কাহিনী রয়েছে, আজ সেই চিম্বুক পাহাড় ম্রোদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। যে চিম্বুক পাহাড় এককালে আমাদেরকে মায়ের সমান আদর আর ভালবাসা দিয়েছিল, আজ সেই চিম্বুক পাহাড়ে আমরা মা হারা সন্তানের মত জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছি।
গত ০৮ নভেম্বরে চিম্বুক পাহাড়ের কাপ্রু পাড়া এলাকায় ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে যে মানববন্ধন হয়েছিল আজ তার ১২ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, আমাদের হাতে হাত মিলিয়ে নানা জায়গা থেকে অনেক প্রতিবাদ, মানববন্ধন এবং সমাবেশ হয়েছিল। তাই সর্ব প্রথমে তাদের সকলের প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর এটাও আশা করছি আগামীতেও তারা আমাদের সাথে থাকবেন। এত প্রতিবাদ, এত সমাবেশ হওয়ার পরও আমরা আশা করতে পারি না যে, এই জায়গা আমরা নিশ্চিত ফিরে পাবো। তবু মন মানছে না, তাই বসে না থেকে চিম্বুকের পুরনো গল্প মানুষকে শোনাতে চেয়েছি। আর এই পুরনো গল্প মানুষকে শোনাতে পারার মধ্যে নিজের মধ্যে কেমন যেন ভাল লাগা কাজ করে। চিম্বুক পাহাড় সম্পর্কে কোন কিছু লিখতে পারলে নিজেকে মনে হয় অনেক বড় দায়িত্ব পালন করে ফেলেছি। কারণ আমি দেখেছি অনেক ম্রো-ও আজকাল কেমন যেন চিম্বুক পাহাড়ের সমস্যার কথা শুনে না, জানে না। তারা খুব ভদ্র। কারণ তারা কারো বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করতে চায় না। তাদের চিম্বুক পাহাড়ের ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে কথা বলতে কেমন যেন দ্বিধা। কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হয়ে কিছু কথা বলতে পারলে যেন তাদের সব দায়-দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। চিম্বুক পাহাড়ের সমস্যার সম্পর্কে লিখতে আমার মন সারাক্ষণ ছটফট করে। আর এই অভ্যাসটা আজকের নয়, অনেক দিনের। কারণ আমি চিম্বুক পাহাড়কে সব সময় আমাদের মাতা জ্ঞান করি। মাতা যেমন আমাদেরকে দুধ দিয়ে বড় করে তোলে ঠিক তেমনি এই চিম্বুক পাহাড়ের আলো-বাতাস খেয়ে আমরা বড় হয়েছি। তাই এই চিম্বুক পাহাড়ের দুর্দিনে আমি চুপ করে থাকতে পারি না। চিম্বুক পাহাড়ের কান্না, চিম্বুক পাহাড়ের আর্তনাদ সম্পর্কে আমি আজীবন লিখে যাবো।
সবেমাত্র বর্ষাকাল শেষ হয়েছে। অনেকের জুমে ধান পাকতে শুরু করেছে। আমাদের পরিবারের লোকজন জুমে যেখানে ধান পাকছে, সে স্থানে কাটা শুরু করেছে। আমাদের জুম ছিল চিম্বুক রাস্তার পাশে, বলতে গেলে চিম্বুক রাস্তার লাগালাগি। সেই বছর আমাদের চিম্বুক রাস্তায় বিদুৎ তারের পিলার বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল। চিম্বুকের রাস্তা ছিল কাঁচা। একদিন আমি মা-বাবা আর ভাই-বোনদের সাথে জুমে কাজ করতে গিয়েছিলাম। আমাদের জুম ছিল ১৪ মাইল দূরত্বে বর্তমান সিংতুই পাড়ার পাশে। আমি জুম ঘরে থাকতাম আর তারা সারিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে জুমের পাকা ধান কাটতো। আমি ছোট বলে আমাকে কাজ করতে হয়নি। আমি জুমের চারদিকে ঘুরি আর মাঝে মাঝে জুমের শসা (ঙুই উই) খাই। মা আমাকে জুম ঘরে থাকতে বলতো কারণ জুমে অনেক বিষাক্ত পোকামাকড় থাকে। জুমের পাকা ধান দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ হলাম। জুম ঘরে থাকার আমার কোন ইচ্ছা হতো না। আমার মা-বাবা আর ভাই-বোন গান গেয়ে গেয়ে কাজ করতে থাকে। হঠাৎ বাবা আমাকে জানালেন, চিম্বুক রাস্তায় নাকি গাড়ি আসছে। আমি রাস্তার পাশে গাড়ি দেখতে গেলাম।
কিন্তু গাড়ির শব্দে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি গাড়ি দেখতে পেলাম না। পরে দুপুরের ভাত খাওয়ার সময় তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, গাড়ি দেখতে কেমন? আমি অনুমান করে বললাম, গাড়ি দেখতে জুম ঘরের মত। আমার কথায় তারা অবাক হলেন। আমাদের জুম চিম্বুক পাহাড়ের অনেক উঁচু জায়গায় বলে জুম থেকে চারদিকের অনেক কিছু দেখা যেতো। এসবের মধ্যে রয়েছে লোহাগাড়া বাজার, কক্সবাজারের রাস্তা আর চিম্বুক টাওয়ার। দূর থেকে লোহাগাড়া বাজারের টিনের ঘরগুলো দেখতে চকচক করে। মা বলতেন, এই চকচক করা ঘর নাকি ধনীদের। আমি অবাক চোখে দেখতাম চকচক করা টিনের ঘরের দৃশ্য। আমি ভাবতাম জীবনে এই রকম রূপার মত চকচক করা ঘরে থাকতে পারবো কিনা!
দিদিদের সাথে নানা কথা হতো। বড় বড় ও বেশি চকচক করা ঘরকে নিজের ঘর বলে দাবি করতাম। চিম্বুক টাওয়ারকে আমরা বলতাম ‘এরা ম্রো টাওয়ার’। গ্রামবাসীরা বলতেন, আমাদের এলাকার এরা ম্রো নামের এক লোক সেই টাওয়ার নির্মাণ করেছিলেন। সেই কারণে টাওয়ারের নাম রাখা হয় ‘এরা টাওয়ার’।
একদিন আমি আমার মা আর বাবা এক সাথে গিয়েছিলাম বড় দিদি রিয়েনকে দেখতে পটেসিং পাড়ায়। ওখানে দিদির বিয়ে হয়েছিল। পটেসিং পাড়ায় চিম্বুকের রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। সেবার বাবা আমাকে বললেন, নীলাদ্রি এলাকায় নাকি আর্মিরা ক্যাম্প করবে। তখন সেখানে অনেক জঙ্গল ছিল। আমি বাবার কথায় হেসে উড়িয়ে দিলাম। কারণ এত জঙ্গলে কিভাবে ক্যাম্প করবে। তাছাড়া সেই জায়গা ছিল সিমলোং পাড়া লোকদের। আমাদের জানা ছিল না যে, একজনের জুমের জায়গা আরেকজন জোর করে দখলে নিতে পারে। তাছাড়া মাতার সমান পবিত্র পাহাড়কে বিক্রি করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। কারণ এতদিন দেখে এসেছি, আমাদের মানুষ মাতার সমান পবিত্র পাহাড়কে বিক্রি করাতো দূরে থাক, নানা পূজা করে ভগবানের সমান পবিত্র জ্ঞান করে।
সেবার দিদি রিয়েন সিংপাত একটি কেরোসিনের লাইট বান্দরবান থেকে কিনে আনলেন। রাতে লাইট দেখতে দিদিদের ঘরে অনেক মানুষের জমায়েত হলো। তারা আমাদেরকে মোরগ কেটে ভাত খাওয়ালেন। পরে যাওয়ার সময় দুটি মোরগ দিয়ে দিলেন। দিদিদের গ্রাম থেকে আমাদের ঘরে ফিরে আসার পর আমার মুখ আর বন্ধ থাকল না। রাস্তায় এবং দিদিদের গ্রামে যা কিছু দেখলাম তা সবই বন্ধুদেরকে বলতে থাকলাম। সামান্য দূরে যাওয়াকে আমি সারা পৃথিবী ঘোরা মনে করলাম। তখন আমার বন্ধুরা আমার কথা অতি মনোযোগ দিয়ে শুনে।
এর কয়েকদিন পরে আমাদের নতুন বিহারে (ক্রামা মন্দির) কাজ শুরু হয়। গ্রামবাসীরা বিহারের পিলারের জন্য জঙ্গল থেকে বড় বড় গাছ কাটে। পরে সেইগুলো পুরো গ্রামের মানুষ টেনে নিয়ে আসে। আমরা যারা ছোট তারাও অনেক আনন্দে তাদেরকে সাহায্য করি। গ্রামে কারবারী ঘরে সভার জন্য গ্রামে একবার ডাক দিলে গ্রামবাসী হুড়হুড় করে চলে আসে। এর কয়েকদিন পরে আমাদের নতুন বিহারে কলা চারা রোপনের কাজ শুরু হল। বিহারে যিনি থাকেন তিনি আমাদেরকে মজুরী দিতেন, দিন প্রতি সাত টাকা। আমি দুইদিন কলা চারা রোপণ করে চৌদ্দ টাকা পেলাম। এই চৌদ্দ টাকা আমি আর ঘরে রাখার জায়গা পেলাম না। কোন জায়গায় এত টাকা রাখবো তা আমার জানা ছিল না। এক জায়গায় রেখে পরক্ষণে আবার অন্য জায়গায় সরিয়ে রাখতাম। আমার ঐ অবস্থা দেখে আমার দিদি লেংপাও, দিদি রুইচুম আর দিদি সংলেং হাসতে থাকেন। তাদের কাছে হাসার কারণ হলেও আমার কাছে তা ছিল খুবই সত্য। জীবনে এই প্রথম এত অঙ্কের টাকা হাতে পেলাম। তাও আবার নিজের কষ্টের টাকা! এর ঠিক তিন দিন পর দিদি লেংপাও আমাকে তার ঘড়ি দিয়ে দিলেন। ঘড়ি পেয়ে কি যে ভাল লাগল তা বুঝিয়ে শেষ করতে পারবো না। কাটা ঘড়ি হওয়ায় আমি সময় বুঝতাম না। কিন্তু মানুষের সামনে সব সময় ঘড়ি দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
একদিন ঘটল এক হাস্যকর ঘটনা। আমাদের গ্রামের এক লোক বাজারে যাবে বলে আমাকে সময় জিজ্ঞাসা করলো। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, একটা বাজে! সে বলল, এখনতো সবেমাত্র সকাল হয়েছে, তবে কেন এত তাড়াতাড়ি একটা বেজে গেল! সে আমার হাতের ঘড়ি দেখে নিল। সে আমাকে বোকা মনে করল। কারণ তখন সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। সেদিন থেকে লোকটার সামনে যাওয়া আমার কাছে বাঘের কাছে যাওয়ার মত মনে হল। সব সময় তাকে এড়িয়ে চলতাম। তবে তিনি অনেক ভাল লোক ছিলেন। আমাকে ভাল চোখে দেখতেন। তার ছিল একমাত্র মেয়ে। তার নাম তুমলে। একমাত্র মেয়ে বলে তাকে খুব আদর করতেন। আমার মেজো দিদি রুইচুমের সাথে তুমলের ছিল খুব সদভাব। তুমলে, দিদি রুইচুম, চিকইয়ো আর তুমপং তারা একসাথে আমাদের ঘরে ঘুমাতেন। আমার বন্ধু তনসিং, থংওয়ই, তাংলাই, কসাই, প্রেনপং, মেনচ্যং আর পাসাই। তবে পাসাইয়ের ঘর আমাদের ঘর থেকে দূরে ছিল বলে তার সাথে দেখা হত অনেক কম। তুমলেদের ঘরে গেলে তার মা সংলত সব সময় আমাকে ভাত খেতে বলতেন। ভাত খেতে না চাইলেও মাঝে মাঝে খেতেই হতো।
এক শীতের রাতে দিদি লেংপাও, দিদি রুইচুম, তুমপং, তুমলে আমাদের বললো, এই শীতের রাতে গোসল করতে পারবে কিনা! এখানে আরেকটি কথা বলা ভালো যে, আমার বন্ধুসহ আমরা আমাদের ঘরে এক সাথে ঘুমাতাম। সেদিন থংওয়ই আর কসাই দিদিদের কথায় রাজি হয়ে যায়। পরে আমি আর তনসিংও তাদের সাথে রাজি হয়ে গেলাম। জানুয়ারী মাসের রাতে কনকনে শীতের রাতে আমরা গোসল করলাম। রাত তখন দশ কি এগারোটা বাজে। গোসল করে আমরা ঘরে ফিরে উনুনের পাশে আশ্রয় নিলাম। আমার নিজের শরীরকে নিজের বলে ভাবতে পারলাম না। আমার শরীর যেন কোন শরীর না, আস্ত একটা কাঠের টুকরো। নিজেকে মনে করলাম ক্ষণিকের মধ্যে আমি জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যাবো। পরে উনুনের পাশে প্রায় এক ঘন্টা থাকার পর কিছুটা ভাল লাগল। আমাদের কান্ড দেখে দিদিরা হাসতে থাকে। তবে তাদের হাসার কারণ শেষে পরিণত হলো কান্নায়। সকালে আমাদের ঘটনা শুনে মা বাবা তাদেরকে অনেক গালি দিল। গালি খেয়ে দিদি রুইচুম সেদিন জুমে গেল না। আমি ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট বলে মা-বাবা আমাকে আলাদা চোখে দেখতেন। বিশেষ করে আমার বাবা! আমি নাকি বাবার বাবা রুমতুই হয়ে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছি, তাই বাবা আমার কান্না সহ্য করতে পারতেন না।
দিদি রুইচুম সারাদিন আমার সাথে কথা বললো না। আড়চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকাতো। আমি তাকে ডাক দিলেও তিনি না শোনার ভান করেন। আর সাড়া দিলেও রাগের সাথে উত্তর দেন। আমি বুঝতে পারলাম দিদি আমাকে রাগ করেছে।
পরে সন্ধ্যায় জুম থেকে মা-বাবা আর ভাই-বোনেরা ফিরলো। সে রাতে আমরা একটি শুকর জবাই করলাম। জুম কাজে কষ্ট হওয়ায় শুকর জবাই। সেদিন রাতে অতি আনন্দে আমরা শুকর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম।
এর কয়েকদিন পর আমাদের বিহারে যিনি থাকেন তিনি আমাদেরকে সাথে নিয়ে গেলেন বার মাইলে (বর্তমান ওয়াই জংশন)। তাঁর নাম লেংইয়াং ম্রো। তিনি ক্রামা ধর্ম পালনের জন্য বিহারে থাকেন। সেবার আমরা লেংইয়াংর সাথে তিনজন গেলাম। আমি, তনসিং আর থংওয়ই। আমাদের গ্রাম থেকে বার মাইলের দূরত্ব ছিল মাত্র ছয় কিলোমিটার। কিন্তু এই সামান্য দূর হলেও সেখানে যাওয়া আমাদের সৌভাগ্য হতো না। সৌভাগ্য মনে করে সেদিন আমরা অতি আনন্দে গেলাম বার মাইলে। আমি সাথে নিয়ে গেলাম আমার কষ্টে উপার্জিত তিন টাকা। বাবা আমাকে বললো, এত বেশি টাকা নিয়ে যাওয়া অনর্থক হবে। আমরা চৌদ্দ মাইল পথ দিয়ে গেলাম। রাস্তায় পৌঁছে আমরা অনেক ভয় পাই। চিম্বুক রাস্তা নতুন করা হয়েছে। সবেমাত্র কারেন্ট তারের পিলার দেওয়া শুরু হয়েছে। বাতাসের সাথে তারের মিলনের ফলে শব্দ সৃষ্টি হয়। তা শুনে আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। লেংইয়াং আমাদেরকে বললো, ভাগ্য থাকলে গাড়ি দেখতে পাবো।
গাড়ি দেখার জন্য আমাদের মন ছটফট করতে থাকে। রাস্তার আশেপাশে বড় বড় গাছ আর ঘন জঙ্গল ছিল। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমাদের গায়ে রোদ লাগতো না। তখনো ভাঙ্গা ইটের রাস্তা ছিল। রাস্তা ছিল খুব ছোট। কারেন্ট তার এখানে সেখানে পড়ে ছিল। গ্রামের যুবকেরা সেই তার কেটে হাতের চুড়ি বানাতো। অনেকে তার নিয়ে গরম করে নিজেদের পছন্দ মতো চুড়ি তৈরী করে। সারা পথ ধরে আমাদের চিন্তা ছিল, গাড়ি দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা! শেষে আমরা বার মাইল বাজারে পৌঁছে গেলাম। দোকানদার সকলেই ছিল ম্রো। লেংইয়াং বাজার করল। বাজার বলতে তিনি আগরবাতি আর লুঙ্গি কিনলেন। আমরা চা খেলাম আর সাথে বিস্কুট। কিন্তু আমাদের মনে ছিল অন্য ভাবনা। সারাদিন যে কষ্ট করে গেলাম তা কি সার্থক হবে! যাত্রা সার্থক করতে অবশ্যই গাড়ি দেখা চাই! এত কষ্ট করে গেলাম কোন কিছু কেনার ইচ্ছা ছিল না। শুধুমাত্র গাড়ি দেখার ইচ্ছা ছিল। পরে বিকাল হলে আমরা গ্রামের দিকে ফিরি। গাড়ি দেখতে না পেয়ে ঘরে ফিরতে হবে! এই কথা ভাবতে কেমন যে খারাপ লাগলো।
আমরা নিরাশ হয়ে ঘরের দিকে ফিরে গেলাম। আর কখন এত দূরের পথে আসতে পারবো কিনা ভাবতে ভাবতে মন খুবই খারাপ হল। হাঁটতে হাঁটতে শেষে আমরা আমাদের গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ গাড়ির শব্দ শুনে আমরা দৌঁড় দিয়ে রাস্তায় গেলাম। পাহাড়ী পথে দৌঁড় দিতে আমাদের কোন কষ্ট হল না। লেংইয়াং বলল, এত কষ্ট করে আর রাস্তায় যেতে হবে না। কিন্তু আমরা তার কথা আর মানতে পারলাম না। যে যে রকম পারে দৌঁড় দিয়ে গেলাম রাস্তায়। যার জন্য সারাদিন আমাদের মন অস্থির হয়ে আছে সেটি দেখলাম। একটা ট্রাক চলে আসল। লেংইয়াং নিজেও দৌঁড় দিয়ে আমাদের সাথে রাস্তায় চলে আসলেন। রাস্তা ভাল না হওয়ায় ট্রাক খুব আস্তে করে চললো। হঠাৎ হর্ণ শুনে আমরা ভয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে পড়ি। আমাদেরকে দেখে চালকসহ অন্যরা হাসিতে ফেটে পড়ে। আমাদের দিকবিদিক দৌঁড়াদৌঁড়ি দেখে চালক আরো হর্ণ দিতে থাকে আর হাসিতে ফেটে পড়ে। গাড়ির ভিতরে কারেন্টের তার ভরা ছিল। পরে গাড়ি চলে গেলে আমরা সারাদিনের কষ্ট সার্থক হয়েছে মনে করে ঘরে ফিরি। ঘরে ফিরে গাড়ির কথা বলতে মুখ আর বন্ধ থাকল না।
আমাদের কথা শুনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি বললাম, গাড়িও গরুর মত আওয়াজ করতে পারে। তাতে শুধু যে ছোটরা অবাক হয় তা কিন্তু নয়! বড়রাও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সেদিন থেকে কয়েক মাস কেবল মুখ থেকে গাড়ির হর্ণ দেওয়ার আওয়াজ করি। গাড়ির হর্ণের মত আওয়াজ তুলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌঁড়ে যাই। সারাদিন এমনি করে থাকি। আমাদের দেখে গ্রামের লোকজন অবাক হতেন। অনেকে প্রশংসা আর অনেকে বিরক্ত হয়ে বকুনিও দেন। তবে মোটামুটি সবাই অবাক হতেন। কারণ কোনদিন গ্রামের মানুষ গাড়ির হর্ণ শুনতে পায়নি। আর আমরা গ্রামাবাসীদের অবাক হতে দেখে আরো দ্বিগুণ উৎসাহ পেতাম। আরো বেশি করে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতাম। সাথে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ থাকতো সব সময়। এমনকি রাতে ঘুমের ঘোরেও গাড়ির হর্ণের আওয়াজ করতাম।
আজ আমাদের জায়গা চিম্বুক পাহাড়ে আমরা পরবাসী হয়ে গেলাম। চিম্বুক পাহাড়ে গেলে বাইরের মানুষ আমাদের দিকে বিদেশী মানুষের মত হা করে তাকাতে থাকে। আমাদের প্রাণের চিম্বুক পাহাড় আজ আমাদেরকে কাপুরুষ বলে ধিক্কার জানাতে থাকে। খোঁজ করলে জানতে পারা যায়, এখন সমস্ত চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোদের জায়গা থেকে বহিরাগত মানুষের জায়গা বেশি হয়ে গেছে। যদিও অনেকে এখনও তা প্রকাশ করেনি। এককালে পুরো চিম্বুক পাহাড়ে শুধু ম্রো’রা বাস করতেন। পরে নব্বই শতকে বম জনগোষ্ঠী সেখানে চলে আসে। এখনও দেখলে সহজে দেখতে পাওয়া যায়, ম্রলং ম্রো পাড়া থেকে থানছি পর্যন্ত শুধু ম্রো’রা বাস করে।
এক সময় যেখানে দিনে একবারও গাড়ি দেখা যেত না, আজ সেখানে হাজার হাজার গাড়ি। আমাদের জন্মভূমি চিম্বুক পাহাড়ে এখন আমরা হয়ে গেলাম পরদেশী। আগে ম্রো’রা ম্রো ভাষা দিয়ে দিন, মাস এমনকি পুরো বছর; জীবন চলতে পারতো। আজ সেই ম্রো ভাষা দিয়ে একদিনও চলতে পারে না। না চাইতে বাধ্য হয়ে অন্য ভাষা বলতে হয়। আজ বার মাইলে অপরিচিত মানুষের ঢল নামে। আজ সেখানে কিছু ম্রো’র দোকান আছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। আজ আমাদের জন্মভূমি চিম্বুক পাহাড়ে অপরিচিত মানুষের ঢল। একজন মানুষের ঘর ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে আরেকজন ঘর তৈরী করলে কি রকম অনুভূতি হয় আমাদেরও সে দশা হয়েছে। আমাদের ঘরের ন্যায় চিম্বুক পাহাড়কে আরেকজন দখল করে নিল এটা কিভাবে মেনে নেওয়া যায়। আজ আমাদের সুয়ালক আর টংকাবতী ইউনিয়নের মানুষ কেন এত নিঃস্ব জীবনযাপন করছে? এর উত্তর খোঁজলে খুব সহজে উত্তর পাওয়া যাবে। আমাদের আজ ভাল করে চিন্তা করবার সময় এসেছে। এখনো ঘুমিয়ে থাকলে আর কখন আমাদের ঘুম ভাঙ্গবে? এমনিতে আমাদের গভীর ঘুম আমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আজ আমরা নিজভূমে পরবাসী হয়েছি। চাঁদের ছোট এক ফালির মত এখন আমাদের টংকাবতী আর সুয়ালক ইউনিয়নের মাটি এক ফালি হয়েছে। সেই ছোট ফালি জায়গাও নানাভাবে বেদখল হচ্ছে। আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।
আমাদের জীবন ছিল সাজানো ফুলের বাগানের মত সুন্দর। অথচ আমাদের জায়গা-জমি নানা কৌশল প্রয়োগ করে কেড়ে নিয়ে আমাদেরকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। যে চিম্বুক পাহাড়কে বাঘ-ভাল্লুকের সাথে লড়াই করে আমাদের মানুষ বাসযোগ্য করে তুলেছিল আজ সেই চিম্বুক পাহাড়ে আমরা হয়ে গেলাম পরবাসী। যে চিম্বুক পাহাড়ের সাথে আমাদের মানুষদের পরিচিতি ছিল মাতা-পুত্রের মত, আজ সেই চিম্বুক পাহাড়ে আমরা হয়ে গেলাম বাপ-মা হারা সন্তান। সহজ-সরল আদিবাসীদের জীবনে এই ধরনের দুর্যোগ কেন?
সংগ্রাম বিমুখ জাতি সহজে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আমরা আমাদের অধিকারের দাবি আদায়ের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যাব। তবেই আমরা আবারও আগের মত আত্মসম্মান নিয়ে সুন্দর করে বাঁচতে পারবো।
লেখক: ইয়াংঙান ম্রো, ম্রো ভাষার প্রথম লেখক ও গবেষক।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন