আর্জেন্টাইন উপন্যাসিক জুলিও করতেজার ‘দ্য উইনারস’ উপন্যাসে বর্তমান মারণাস্ত্রময় বিশ্ব মানব সভ্যতাকে উদগিরিত ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের দিকে ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছে— এরূপ চিত্র চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটিতে করতেজার জাহাজের সেইসব একদল যাত্রীর কথা বলেছেন যারা তাদের গন্তব্য কোথায় সেটি তাদের নিজেদের কাছেই অজানা। জাতীয় লটারিতে পুরস্কার জিতে একদল যাত্রী ম্যালকম জাহাজে চেপে রাজধানী বুয়েন্স এয়ার্স থেকে বেরোয়, কিন্তু তারা গন্তব্যহীন। বর্তমান মারণাস্ত্রময় বিশ্ব সমগ্র মানব জাতিকে কি অস্থিরতা, বিভীষিকা আর অনিশ্চয়তা দিয়েছে সেটি উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। জাহাজের যাত্রীরা জানে না তাদের গন্তব্যস্থল, বুঝতে পারে না তাদের ঠিকানা, তারা যেখানে পৌঁছতে চায় সেখানেও তারা পৌঁছতে পারে না, ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই আপন ভুবনে ফিরতে হয়। লেখক অনেকগুলো মানুষকে এক জাহাজের যাত্রী বানিয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের লক্ষ্য এক, গন্তব্যস্থল অভিন্ন এবং এক বিরাট পরিবারের মতো। যে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মৌল চাহিদা এক।
দেখা যায় উপন্যাসটিতে বাস্তব চিত্র উপমার আকারে উপমিত হয়েছে। একবার জাহাজ এক জায়গায় এসে থামে কিন্তু যাত্রীরা কোনো সমাধান পায় না। ঠিক কী কারণে জাহাজ থামানো হয়েছে যাত্রীরা তা-ও জানে না, বুঝতে পারে না, কেউ যাত্রীদের কথার উত্তর দেয় না। জাহাজের ওয়েটাররা যাত্রীদের ভাষা বুঝে না, তাদের নিকট দুর্বোধ্য তাদের ভাষা। শেষ পর্যন্ত ম্যালকম জাহাজের যাত্রীরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি, আশাহত অবস্থায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে আপন ভুবনে। এ থেকে কী লেখক এটিই বোঝাতে চেয়েছেন যে, মারণাস্ত্রময় বিপদাপন্ন পৃথিবীর অধিবাসীদের সামনে আশার আলো নেই? এই প্রশ্নের ফয়সালা হয়নি।
২. অমীমাংসীত প্রশ্নের সুরাহা করা উপন্যাসের কাজ নয়। উপন্যাস গল্পচ্ছলে জীবনের সুখ দুঃখের কথা বলে, সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি, সঙ্গতি-অসঙ্গতি তুলে ধরে, পাঠককে নিয়ে যায় অন্য জগতে, ভাবায়। এখানেই উপন্যাসের স্বার্থকতা। গন্তব্যহীনতার প্রেক্ষিতে করতেজার উপমাকারে চলতি বিশ্বের যে প্রামাণিক চিত্র একেঁছেন, অঙ্কিত সেই চিত্রের সাথে দেশের খেটে খাওয়া প্রান্তিক আদিবাসী মেহনতী মানুষের ঠিকানাহীনতার যথেষ্ঠ অন্তর্মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর বাদে প্রান্তিকবর্গীয় মানুষ কোথায়, কোন ঠিকানায়, কোন লক্ষ্যে পৌঁছতে চায়? জানা নেই। জানা নেই বলেই বলি, আমাদের কোনো লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নেই, নেই মিশন, ভিশন। সম্মুখ অগ্রসর হওয়ার জন্য লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গন্তব্যস্থল থাকা দরকার। নেই, আমাদের কোনোটাই নেই। লক্ষ্যহীনভাবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা কোথায় যাচ্ছি? কেউ জানি না।
স্বভাবতই কেউ কোথাও যেতে চাইলে আগে স্থান বা গন্তব্যস্থল নির্ধারণ করে, পরে সে অনুযায়ী যাত্রারম্ভ করে। গন্তব্যহীন যাত্রার অন্ত থাকে না। আজকে অবস্থান কাল পাত্র-ভেদে আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, ঠিকানা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় ছক, নীতি-কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন। নেই, আমাদের কোনোটাই নেই। আমাদের পূর্ব-প্রজন্ম আমাদের জন্য মিশন ভিশন ঠিক করে যাননি কিংবা তারা যে ঠিকানায় বা যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন বর্তমানে সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাওয়াটা নিছকই যুগের চাহিদাকে উপেক্ষা করার সামিল বলে গণ্য হবে। সময়কে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। সময় ও স্রোত আপন নিয়মে চলে। মানুষকে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে কার্যসিদ্ধি করে নিতে হয়, স্বার্থ উদ্ধার করার কৌশল রপ্ত করতে হয়। নতুন সময় নতুন স্বার্থ সামনে হাজির করে। সময়কে তুচ্ছজ্ঞান করলে যে কেউ সময়েরই অন্তিম আস্তাকুড়েঁ নিক্ষিপ্ত হবে। যেখানে কেউ কারোও খোঁজ রাখে না, খোঁজ নেয় না, খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। এই কালের অমোঘ বাণী।
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে আমাদের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এগিয়ে যাওয়ার জন্য লক্ষ্য ঠিক করা দরকার। পৃথিবীর উন্নত দেশ, জাতি মাত্রই বিভিন্ন লক্ষ্য, বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। খোদ বাংলাদেশ সরকার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ভিশন ২০৪১ প্রভৃতি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে। এই সময় আমাদের প্রান্তিক মানুষের বিপদাপন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির ভিত রচনার জন্য সর্বত্র মিশন ভিশন দ্বার করানো উচিত। নাহলে উদেশ্যহীন ভবঘুরে হয়ে পড়ে থাকবে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, জাতি। আগামী পঞ্চাশ একশো বছরে কী হবে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, প্রথা, রীতিনীতি, শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, সর্বোপরি রাজনীতির? নাকি বড় নৃগোষ্ঠীর (?) সাথে মিশে একাকার হয়ে যাবে সরকার সংজ্ঞায়িত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিচয়? এই বিষয়ে প্রান্তিক বুধমন্ডলী কী ভাবছেন?
৩. বলা হয়ে থাকে সংস্কৃতি জাতিসত্তার মূল উপাদান, জীয়নকাঠি। যদি জাতিসত্তার সংস্কৃতি-ই না থাকে, না টিকে, হারিয়ে যেতে থাকে তবে অটোমেটিক্যালী জাতিসত্তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। যুগে যুগে দেশে বিদেশে এমনই হয়েছে, আগামীতেও এমনি ঘটতে থাকবে। পৃথিবীর যে সকল জাতি আপন সংস্কৃতি ঐতিহ্য লালন প্রতিপালন করে রেখেছে, সেই জাতিসত্তার সংস্কৃতি জাতিকে দিয়েছে অধিকার অর্জনের অনুপ্রেরণা, নতুন মাত্রা, নতুন দিক।
প্রান্তিক আদিবাসী সমাজ সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, প্রথা, সুপ্রাচীন রীতিনীতি অচর্চিত থাকার ফলে অনেক আগেই আদিবাসী জাতিসত্তা বিলীন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। জাতিসত্তাকে যদি বৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয় তবে সেই বৃক্ষের মূল হচ্ছে সংস্কৃতি, বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মূলের ন্যায় নয়। বৃক্ষের জন্য মূলের মাহাত্ত্ব অত্যধিক। বৃক্ষের কোনো অংশের সাথে মূলের তুলনা চলে না। মূল ব্যতীত বৃক্ষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। আদিবাসী জাতিসত্তা সমূহের মূল হচ্ছে আদিবাসী সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি যদি না থাকে, না টিকে তবে আদিবাসী জাতিসত্তার অস্তিত্ব থাকবে কী করে?
আমরা দুঃখভার হৃদয়ে বিদৎ সমাজকে প্রায়শ অভিযোগ করতে দেখি, এই সংস্কৃতি ধ্বংসে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ আছে। উত্থাপিত এই অভিযোগ একদম ফেলনার নয়। বাংলায় প্রচলিত বহুল প্রবাদ এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য— ‘গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা’। আমাদের দেশের প্রান্তিক আদিবাসী মানুষের বেলায় রাষ্ট্রের এহেন আচরণ দৃশ্যমান। আদিবাসী মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষা না করে উপরি সংস্কৃতি চর্চায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক একাডেমি স্থাপন কী বার্তা দেয়? তথাকথিত এইসব সাংস্কৃতিক একাডেমি কিংবা সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউট নির্মাণ করে কী আদৌ সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব? পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বত্র সেটেলার অনুপ্রবেশ, অবকাশ যাপন কেন্দ্র, মিলিটারি ব্যস ক্যাম্প, লেক-রিসোর্ট নির্মাণ, পাহাড়ি জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করে কী সংস্কৃতি রক্ষা করা যায়? এভাবে কোনো জাতিসত্তার সংস্কৃতি রক্ষা পায়? কিংবা ঢাকা শহরে বছরে একবার দু’বার আদিবাসী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা করে? বা দেশের বৃহৎ কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পালা-পার্বণ উৎসবে আদিবাসী শিল্পীদের নাচ গানের সুযোগ দিয়ে? না, এভাবে কোনো জাতিসত্তার সংস্কৃতি রক্ষা করা যায় না। অনুষ্ঠানের উপর নির্ভর করে জাতিসত্তার সংস্কৃতি রক্ষা পায় না। সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউট বা সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন করে সংস্কৃতি রক্ষা করা যায় না। সংস্কৃতি চর্চার জন্য সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠন করে সংস্কৃতিকে বিশেষ রূপ ও মাত্রা দেয়া সম্ভব নয়।
সংস্কৃতি সর্বজনীন। মানুষের জীবনাচরণের মাঝেই সংস্কতির অস্তিত্ব। মানুষ যা কিছু করে তাই যেহেতু সংস্কৃতি সেহেতু আদিবাসী মানুষ পূর্ব পুরুষের রীতিনীতি প্রথার চর্চা যদি নাই করতে পারে তবে সংস্কৃতি কী প্রকারে টিকবে? প্রশ্নের প্রেক্ষিতে যদি বলা হয়, পার্বত্যাঞ্চলে জুম্ম জাতির স্বতন্ত্র জীবন যাপনের অধিকার না দিয়ে আশির দশকে তদানীন্তন সরকার সেটেলার অভিবাসনের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন করে সেক্ষেত্রে কী বলা যায়? জুম্ম জাতির সাংস্কৃতিক শেকড় উপড়ে ডালপালায় জল সেচন করে কী সংস্কৃতি রক্ষা করা যাবে? এভাবে কোনো জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি রক্ষা করা যায় না, সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণের অর্থ হবে সংঘর্ষকে আমন্ত্রণ জানানোর শামিল। সংস্কৃতি রক্ষা চর্চার জন্য স্বতন্ত্র জীবনযাপন অর্থাৎ আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার থাকা চাই-ই চাই। নইলে জাতিসত্তার সংস্কৃতি রক্ষা পাবে না। এই সংস্কৃতি রক্ষার জন্য প্রান্তজনের উচিত মিশন ভিশন দাঁড় করানো। ভিশন মিশন না থাকলে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো না, দিকভ্রান্ত হবো, দিকভ্রান্ত হয়ে হন্যে হয়ে ঘুরবো, ঘুরবে পরবর্তী উত্তর প্রজন্ম।
৪. বন প্রকৃতি নির্ভর আদিবাসী জীবন। প্রকৃতিকে ঘিরে আদিবাসী জীবন আবর্তিত হয়। তা-ই আদিবাসী মানুষ প্রকৃতির প্রতিটি বৃক্ষরাজি, লতা-গুল্ম, নদী, পশু পাখিকে আপন ভাইবোনের মতো আদর যত্ন পরম মমতায় স্নেহ করে। অতীতে ভাতের বেগারে পড়লেও আদিবাসীদের কখনো তরকারির অভাবে পড়তে হয়নি। বনের লতাপাতা আদিবাসীরা সবজি হিসেবে ব্যবহার করে, ফলে সবজির অভাব সহজেই পূরণ হয়। পাহাড়ের ছোট ছোট ঝিরি-নালা বাঁধ বেধেঁ আদিবাসী মানুষ মৎস শিকার করে। অল্প সময়েই খালয় ভর্তি মাছ মারা যেতো। উৎপাদিত খাদ্য ফুরোলে প্রকৃতি আদিবাসী মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।বন আলু, লতা-গুল্ম খেয়ে আদিবাসী মানুষ জীবন ধারণ করতে পারে।
এই তো গেল আশি নব্বই দশকে যখন গারো পাহাড়ে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয় তখন দলবেঁধে গারো সম্প্রদায়ের লোকজন বন আলু তুলতে যেতো। বন আলু তোলার অভিজ্ঞতা আমারও আছে। বড় কাপড়ের থলে (গারো ভাষায় যেটাকে বলে দকড়া), ধারালো দা, শাবল আর কোদাল নিয়ে আমিও মায়ের পিছু নিয়েছি, জঙ্গল ঘুরে ঘুরে বন আলুর লতা খুঁজতে সাহায্য করেছি, মা পরিশ্রান্ত হলে মাটি খুড়েছি, এভাবে বন আলু সংগ্রহ করেছি। সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ফিরে সেই বন আলু বড় পাতিলে সেদ্ধ করে পরিবারের সবাই রাতের আহার সেরেছি। সকালের বন্দোবস্তও একই। সপ্তাহে অন্তত দু’তিন বার কখনোবা চারদিন গ্রামের পুরুষেরা দলবেঁধে জাল, ফালা, দা নিয়ে বন্য শুকর শিকারে বের হতো। শিকার মিললে মাংস কেটে সবার মাঝে সমানভাবে বণ্টন করা হতো। এভাবে আমাদের অন্নের চাহিদা পূরণ হয়েছে। এ তো আমার দেখা অভিজ্ঞতা। এটিই ছিল আমাদের আদিবাসী অর্থনীতি। কিন্তু এখন আর এসব নেই। ভঙ্গুর হয়ে গেছে সে অর্থনীতি, ফলে গ্রামে টিকে থাকা আদিবাসী মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই আদিবাসী মানুষকে শহরমুখী হতে হয়েছে। শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত আদিবাসী পুরুষেরা শহরের বাসা-বাড়ির দারোয়ান, অফিসের পিয়ন, গার্মেন্টস, বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকের কাজ নেয়। মেয়েরা বিউটি পার্লার, বাসা-বাড়ির আয়া, বিভিন্ন অধস্তন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে। শহরে পড়ুয়া আদিবাসী শিক্ষার্থীরা টিউশনি, বিভিন্ন সেলসের কাজ করে পড়াশোনার খরচ বহন করে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে শহরে এসে আমরা আমাদের প্রথা, ভাষা, সংস্কৃতি ভুলে হারাতে বসেছি? গ্রামে অবশিষ্ট থাকা পূর্ব পুরুষের জমি জিরাত খুইয়ে বসতে বসেছি? বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর আগ্রাসনের প্রবল জোয়ারে ভাসমান দেশের সংখ্যালঘু জনজাতির মানুষ আগামী দিনে কোন গন্তব্যে পৌঁছাবে? কোন গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়?
৫. আদিবাসী জীবন প্রকৃতির সাথে যেমন আবর্তিত হয় তেমনি পরিচালিত হয় নিজস্ব ব্যবস্থায়। আদিবাসী সমাজে নিজস্ব প্রথা, রীতিনীতি দেখা যায়। যেমন গারো সমাজ ব্যবস্থায় গ্রামে একজন নকমা (গ্রাম প্রধান) থাকেন, যিনি গ্রামের ভালোমন্দ সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদানপূর্বক গ্রাম পরিচালনা করেন। নকমা গ্রামের যাবতীয় শালিসী বৈঠক, ঝুট মীমাংসা করা থেকে শুরু করে নির্ধারণ করে দেন কে কোথায় জুম চাষ করবেন, গ্রামবাসী কখন পূজা-অর্চনা, উৎসবাদি পালন করবেন প্রভৃতির তারিখ ঠিক করেন। এই নকমাদের নেতৃত্বেই গারোরা সংগঠিত হয়েছেন, ইংরেজ জমিদার জোতদার মহাজনের শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত লড়াই গড়ে তুলেছেন। তদানীন্তন বৃটিশ সরকার যখন গোয়ালপাড়া, কামরূপ, খাসি হিলস ও বাংলাদেশের গারো অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো বাইরে রেখে গারো হিলসের সীমারেখা নির্ধারণ করেছিলেন তখন গারোরা বৃটিশের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি।গারো হিলস বা মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ও খন্ডিত করা গারো অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো গারো হিলসে অন্তর্ভূক্ত করে পৃথক রাজ্য, আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সোনারাম আর সাংমার নেতৃত্বে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। সেই সংগ্রামে গারো গ্রামের নকমারা আর্থিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছেন। আঠারো শতকে ছপাতি নকমা গারো পাহাড়ের গারো, হাজং, কোচ, ডালু, মেচ, হাড়ি প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীকে ইংরেজ পোষ্য জামিদার জোতদারদের শাসন শোষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।যদিও রাজনৈতিক এই সংগ্রাত আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই রাজনৈতিক আন্দোলন গারো সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এখানেও দেখা যায়, গারো সমাজপতি নকমার অসামান্য অবদান।
বর্তমানে ভারতের গারো সমাজে নকমা কাঠামো দেখা গেলেও বাংলাদেশের চলতি সমাজ ব্যবস্থায় নকমার অস্তিত্ব নেই, থাকলেও নামে মাত্র, নখ দন্তহীন বাঘের মতো। পাকিস্তানি আমলে গারো ময়মনসিংহের পাঁচ সীমান্তবর্তী থানা স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা খোয়ালে এখানকার অ-বাঙালি জাতিগোষ্ঠী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিকে থেকে প্রবল আগ্রাসনের মুখে পড়ে। আদি নকমা, মোড়ল ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।ভেঙ্গে পড়াটাই স্বাভাবিক কেননা পুরো ভবন যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন দ্বারপাল কেবল দ্বার রক্ষা করতে পারে না। রাজনৈতিকভাবে একটি জাতিগোষ্ঠী অপরিচয়হীন বা দেওলিয়া হয়ে পড়লে সেই জাতিগোষ্ঠীর অন্যান্য সকল পরিচয় বানের জলের ন্যায় ভেস্তে যাবে, এতো সহজ ব্যাপার।
লেখক : উন্নয়ন ডি. শিরা, প্রবন্ধকার।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন