শখের মোচ বৃত্তান্ত, মোচের বিড়ম্বনা

পরাগ রিছিল

ড্রাইভারদের সরকার যেমন লাইসেন্স দেয় বিশ্বরোড বা সারাদেশের রাস্তাঘাট দিয়ে গাড়ি চালাবার, রতন মামাদের লাইসেন্স দেয় সারাদেশের ডোবা-নালা-বাড়ির পিছন দিয়ে পথ চলবার। এই পথ চলা যে একপাল ওয়াক নিয়ে-! ডোবানালার কচুঘেঁচু খেতে খেতে, ঘোঁৎঘোঁৎ শব্দে পথ চলতে থাকে একপাল ওয়াক। খাইয়ে খাইয়ে, তাড়িয়ে তাদের সঠিক পথের নির্দেশনা দেয় রতন মামাদের মতো দু’তিনজন মানুষ। তাদের সাথে কথা বলবার একটা নির্দিষ্ট ভাষা রয়েছে। এই প্রজাতির সাথে সে ভাষাতেই কথা বলেন রতন মামারা। তাদের ভাষা ঠিক বুঝতে পারেন ওয়াক বা শূকরেরর পাল।

কথা সেইটা না, কথা হচ্ছে রতন মামার অনন্য মোচ। সেই মোচ বা গোঁফ ঘিরে রতন মামার জীবনে ঘটে যাওয়া অভূতপূর্ব সব ঘটনাবলি। যেগুলোর কোন কোনটি অপ্রত্যাশিত, অপ্রস্তুতকর, কোনটি লোমহর্ষক! এই সর্বশেষ অভিজ্ঞতা যেমন, হলি আর্টিজানের হামলার পরপর। তখন দেশের কিছু কিছু স্থানে হত্যার হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি দেয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। হত্যার হুমকিসহ তেমনি এক চিঠি পেয়েছিল রতন মামাদের এলাকার মিশনের ফাদার। ঠিক সে সময় ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ভায়রার ছেলে। ছেলের নাইটের গাড়িতে আবার ঢাকা ফিরবার কথা। গ্রাম থেকে নিয়ে আসবে নানা ফসল-সবজি। সেগুলো ভরতে ভরতে শেষমেষ দুই বস্তা হয়ে গেল। মাঝরাতে ভায়রার পুত্রের সেগুলো নিয়ে একা একা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছা কষ্টকর। রতন মামা বললেন, ঠিক আছে সমস্যা নেই, আমি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিব। ফেরার পথে একা হবেন বলে ভায়রা বললো, আমিও সাথে যাই। নাছোড়বান্দা ভায়রা গেলেন সাথে। বিপত্তিটা ঘটল বাসস্যান্ড থেকে ফেরার সময়।

রাস্তায় মিশন গেটের কাছে পৌঁছতেই অস্ত্র তাক করে পুলিশ ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে। এত রাত্রে কোথা থেকে আসছো? রতন মামা বললেন, বাসস্ট্যান্ড থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে মামার কথা তার বিশাল মোচটির জন্য। এতোএতো করে বলছেন, তাও বিশ্বাস হচ্ছে না! সবশেষে পুলিশ বললো- কিছু খাইসো? রতন মামা এবার গায়ের শার্ট খুলে পেটের কাছে ‘অপারেশনের দাগ’ দেখিয়ে বললেন- স্যার, আমার শরীরের যা অবস্থা, এই শরীর নিয়ে কিছু খাওয়া যায়? পেটের দাগটা দেখে মন নরম হল পুলিশের, সে যাত্রায় মিললো মুক্তি!

একবার শীতের সময় বাড়ি থেকে দূরের গাবতলী বাজারে জমজমাট মেলা চলছে। সারা এলাকায় মাইকিং হয়েছে। দিনরাত চলছে মেলা। এলাকার অনেকজন ঘুরে এসে নানা গল্প শোনাচ্ছে সেই মেলার। দীপক পালের মুখাবয়বেও তখন লম্বা মোচ ছিল। দীপক পালের মোটরসাইকেল আছে। দীপক পাল আর রতন মামা দু’জন মিলে ঠিক করলেন, যাবেন মেলা দেখতে। সারাদিন মেলা দেখে ফিরে আসবেন বিকেলে। ভোর চাটটায় শুরু করলেন যাত্রা। সে রাস্তায় বন-জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হয়। জঙ্গল পেরিয়ে মেইন রোডে উঠতেই আটকালো পুলিশের একটি গাড়ি। “তোমরা কি ডাকাত? এত ভোরে এই জঙ্গলের রাস্তা থেকে বেরুলে?” “আমরা পুলিশরাই রাতে এই রাস্তা এড়িয়ে চলি- ” জেরা চলছে। স্যার, আমরা ডাকাত নই তবে বলতে পারেন আমাদের সাহস আছে! রতন মামা বললেন, স্যার ডাকাত দলের সামনেও যদি পড়তাম, তাহলেও তারা আমার মোচের দিকে তাকাতে তাকাতেই তো আমরা তাদের পিছনে ফেলে দশ হাত সামনে চলে আসতাম…। পুলিশ স্বীকার করল, তা অবশ্য ঠিক! পুলিশের কাছে ব্যখ্যা করে জানালেন, তাদের যাত্রার উদ্দেশ্য, মেলার কথা। পুলিশ তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ছেড়ে দিল।

শূকরের ব্যবসা করতে গিয়ে রতন মামার ঘুরা হয়েছে সারা বাংলাদেশ। পাবনা, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, নাটোর, কালীগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও- হিলি, চলনবিল। যমুনা ব্রীজ হওয়ার আগে হেঁটেহেঁটে দেশের নানা জায়গায় পৌঁছতে লেগে যেত পনের -বিশদিন থেকে এক-দু’মাস। ব্যবসা বলতে, মহাজন আগেই টাকা বা অনেকগুলো শূকর দিয়ে দিতেন, সেগুলো চরিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে বিক্রি করে মহাজনকে টাকা ফেরত দিতে হতো। লাভসহ মহাজনের টাকা ফেরত দিয়ে যেটুকু বাকি থাকে, কেবল সেটুকু নিজের।

এক সময় এই ব্যবসায় জড়ালো তার তরুণ দুই ছেলে। জড়ালো বলতে একস্থানে জড়ো করে রাখা শূকরের পাল থেকে দুই-তিনটা নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে হকারের মত বিক্রি। বাবা যে দামে তাদের বিক্রি করতে বলে দেয় তারা তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করে চলে আসে। বাবা যদি বলে দেয়, এগুলো তিন হাজার টাকায় বিক্রি করবে, তারা দুই হাজার টাকায় বিক্রি করে চলে আসে! কয়েকমাস পর তার ছেলেরা যেসব গ্রামে ওয়াক বিক্রি করতে গিয়েছিল রতন মামা নিজে গেলেন সেসব গ্রামে ওয়াক বিক্রি করতে। রতন মামার কাছে ক্রেতারা জানতে চায়, এই ওয়াকেরর দাম কত? রতন মামা বলে তিন হাজার। ক্রেতারা সবাই বলে, “তুমি ভাল না” “তুমি বেশি বেশি দাম চাও।” তার কাছে জিজ্ঞেস করে, “আগে ঐ দুইটা ছেলে যে আসতো ওরা কই? ওরা ভাল, কম দামে বিক্রি করতো।” রতন মামা তার ব্যবসা লাটে ওঠানো দুই ছেলের কথা রাগে মনে মনে স্মরণ করে কষ্টচেপে উত্তর দেয়, ” ওরা কম দামে বিক্রি করতে পারে, ওরা যে তাদের বাপের সম্পত্তি বিক্রি করে!” রতন মামার ঝুলিতে রয়েছে এমন দম ফাটানো বাস্তব জীবনের গল্পও।

ছোট পিকআপে করে যখনই রতন মামা দূর-দূরান্তে একস্থান থেকে আরেক স্থানে ওয়াকের বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় ব্রীজ পার হতেন, প্রতি ব্রীজেই মামাকে আটকানো হতো তার কিম্ভূতদর্শন লম্বা মোচের জন্য। সদুত্তর দিয়ে পার হতে হতো। কমন একটা উত্তর ছিল, ” আমার শখ, আমার আছে তাই আমি রাখছি। আপনার নাই, আপনি রাখেন নাই। আপনার কোন শখ থাকলে আপনি তা পূরণ করার চেষ্টা করেন না?”

মামাকে জিজ্ঞেস করি, এই মোচটার জন্য কতবার পুলিশ ধরল আপনাকে?

– অনেকবার…।

হিসেব করে বের করতে কষ্ট হয়।

এত বিড়ম্বনা যে পোহাতে হয়, কখনো রাগ করে এমন মনে হয়নি যে, ধুর! মোচটাই ফেলে দেই?

– না, একবারও না।

মোচ কেবলই কি বিড়ম্বনাই ডেকে এনেছে মামার জীবনে? কোন সুবিধা বয়ে আনেনি? কিছু সুবিধা এনেছিল বটে! সাগরদিঘা, নারায়ণগঞ্জে বড় বড় সাধুদের সাথে একত্রে বসতে পেরেছেন। জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলার মাজার, শাহজালালের মাজারে গিয়েও এই মোচটার জন্য আলাদা সম্মান পেয়েছেন। সখীপুরের এক মন্দির, যেখানে বসে গুপ্তবৃন্দাবন, বয়সী লোকদের সচরাচর যেখানে ঢোকার অনুমতি মেলে না। কেবল মোচের জন্যই যত্ন করে মামাকে সেখানে নিয়ে বসিয়েছেন!

জগতের সকল মানুষের শখের জয় হোক।

লেখক: পরাগ রিছিল, কবি ও গবেষক।

কোন মন্তব্য নেই

© all rights reserved - Janajatir Kantho