সেদিন পাহাড়ের নিঃস্তব্দ গ্রামে মাঝ দুপুরে হট্টগোল শুনলাম। বেশ দূর থেকে আসা চিৎকারে কি নিয়ে হট্টগোল তা বোঝা না গেলেও অন্তত এটা বোঝা গেল, একটা নারী আর একটা পুরুষ ঝগড়া করছিল। জানতে পারলাম, পাশের কোনো বাড়ির স্বামী আর স্ত্রী ঝগড়া করছিল এক পর্যায়ে যা রূপ নিয়েছিল হাতাহাতি-মারামারি পর্যন্ত। ঘটনার কারণ হিসেবে জানতে পারলাম, ভাত খাওয়ার সময় পুরুষটি তরকারিতে লবণের আধিক্য পেয়েছিল। অতঃপর সমস্ত দায়ভার গিয়ে পড়ল যথারীতি রাঁধুনি স্ত্রীর উপর। দুপুরের কড়া রোদে লবণাক্ত তরকারি খেতে পেয়ে পুরুষটির মাথা চড়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তরকারির বাটি ছুঁড়ে মেরে তাঁর রাঁধুনি স্ত্রীর সাথে যাচ্ছেতাই গালিগালাজের কথোপকথন শুরু করল। ‘মগদাবি’, ‘রাধাবি’ সহ নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করছিল স্ত্রীর এহেন কর্মকে। কেন সে এমন তরকারি রাঁধল! মেয়ে হয়ে যদি তরকারির স্বাদই বুঝতে না পারো, তবে মেয়ে হওয়ার দরকারটা কি ছিল? মরদের মত প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায় না কেন সে! ইত্যাদি ইত্যাদি। এক পর্যায়ে স্ত্রী ও তাঁর কথার নানা প্রতিউত্তর দিতে শুরু করলে স্বামীর মাথা আর ও বিগড়ে গেল। কি? মুখে মুখে তর্ক! মেয়ে হয়ে পুরুষ মানুষের মুখে মুখে তর্ক! ঘরের কাজ ঠিকমতো পারো না, আবার বড় বড় কথা! অমুকের বউকে দেখ! মদ খেয়ে প্রত্যেকদিন ওর স্বামী ঝগড়া করে রাত-বিরাতে! কই? সে তো কোনোদিন স্বামীর সাথে তর্ক জুড়লো না! কোনোদিন তো স্বামীর মুখের উপর কোনো কথা বললো না! তাকেই তো মেয়ে বলে, সেরকম মেয়েই তো বউ হওয়ার যোগ্যতা রাখে! সেরকম মেয়েকেই তো স্ত্রী বলা যায়! ‘মগদাবি’, ‘রাধাবি’, ‘ঘিলে ঘরবি’ ইত্যাদি ইত্যাদি! এভাবে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে মেয়েটির উপর চড়াও হয়ে স্বামী মরিচ বাটার ‘ডালগাচ্চি’ নিয়ে একটা আঘাত করল স্ত্রীকে। অতঃপর স্ত্রী-ও আঘাত পেয়ে আরও অত্যধিক শানিত গলায় কথা বলা শুরু করলে স্বামী লাকড়ি নিয়ে মারা শুরু করল মেয়েটিকে। দুপুরের কড়া রোদে মেয়েটির আর্তচিৎকার খাঁ খাঁ করছিল আশেপাশের পুরো পরিবেশ। পরে আশেপাশের লোকজন গিয়ে ঝগড়ার মিটমাট করে।
এইতো সেদিন ও এক ১২-১৩ বছরের বাচ্চা মেয়ে সম্পর্কে দোকানে যাচ্ছেতাই বলাবলি করছিল লোকজন! মেয়েটি পড়ালেখা পারে তো কি হয়েছে! সারাদিন ঘুরে একটু সুযোগ পেলে! যথেষ্ট বড় হয়েছে মেয়ে, তার মা ঘরের টুকটাক কাজে একটুও সাহায্যের আশা করতে পারে না! শুধু ঘুরাঘুরি আর এর বাড়ি ওর বাড়ি গিয়ে গল্প করাতে পটু। এমন মেয়ে থাকলেও কি না থাকলেও কি! অমুকের মেয়ে তো ওর মতো না। কি সুন্দর ঘরের কাজে পটু। পড়ালেখাতেও পটু। সবকিছু পাকনা। এমন মেয়েই তো চাই। ঠিক এ কথাগুলো, এ প্রসঙ্গগুলো যখন গ্রামের আরেকটা সমবয়সী ছেলেতে এসে আটকালো, তখন দেখা গেল বিষয়টা ভিন্নভাবে বিচার করা হচ্ছে। অমুকের ছেলে ঘুরে ঘুরুক না। ছেলে মানুষ, সে তো ঘুরবে। ছেলে মানুষ কি আর ঘরে বেঁধে রাখা যায়! ঘুরুক! পড়ালেখাটা ঠিকমতো যে করছে সেটাই বা মন্দ কি! তাই বা কম কিসে! এসব ছোটো ছোটো ঘটনাগুলোর সাথে আমরা চাকমারা ও অন্যান্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মত সবাই কমবেশি পরিচিত। এরকম আরও অসংখ্য ঘটনা লিখে শেষ করা যাবে না। ছোটোবেলা থেকে এগুলো শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে এতোটাই আমাদের আত্মস্থ হয়ে গেছে যে, আমরা হয়তো এগুলো স্বাভাবিকভাবেই নিই। কখনো ভাবিও না সেই স্ত্রী বা নারী সম্পর্কে, যে কি না তরকারিতে লবণ বেশি দেয়ায় তাঁর স্বামীর প্রহার উপহার পেল! সেই বাচ্চা মেয়েটির কথা যার বয়সে একটি ছেলে ঘুরে বেড়ালেও দোষ নেই অথচ যত দোষ নন্দিতা ঘোষ। পড়ালেখায় ভালো হয়েও মেয়েটির রক্ষা নেই। মেয়েজাত রক্ষা করতে পারছে না সে, মেয়ের ধর্মের বিপরীতে সে হাঁটছে! সে মেয়ে জাতের বৈশিষ্ট্য, সে ধর্ম কারা ঠিক করে দিয়েছে? সমাজ। সমাজ কারা চালায়? পুরুষেরা। তারাই তো বলে, মেয়েকে এরকমই হতে হবে, ঐ রকম হওয়াই যাবে না!
এখন হয়তো আমরা কিছুটা বুঝতে পারবো ঠিকি, কিন্তু আমরা যখন ভবিষ্যতে পুরুষরূপী শাসক হবো, তখন সেই শোষকের ভূমিকা আমরা নিজেরাও পালন করবো! ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারবো না, এ কাজটি তো করা উচিত না! যেহেতু সেটা আমরা ছোটকাল থেকে স্বাভাবিকভাবেই দেখতে দেখতে বড় হয়েছি, কোনো না কোনো ভাবে আমরাও সেটা কখন যে নিজের চরিত্রের ভেতর আত্মস্থ করে নিয়েছি বিন্দুমাত্র টের পাবোই না, ফলে আজ আমরা সেই একই আচরণ করবো।
এরকমই হয়। একটা প্রবাদ আছে, ‘দেখাদেখি কর্ম, শুনাশুনি ধর্ম’। আমরা যা দেখবো, যা শুনবো তাই অবচেতনভাবে আমাদের চরিত্রে স্থান করে নেবে আস্তে আস্তে। সমাজের চালিত এমন অনেকগুলো নীতি আমাদের ভাবনার দ্বারকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে শতাব্দী থেকে শতাব্দী পর্যন্ত। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা এরকম অসংখ্য অজ্ঞতার সাগরে ডুব দিয়ে অবচেতন মনে ভেসে চলেছি। কারণ সমাজ আমাদের কিছু শিকল বেঁধে দিয়েছে। সে শিকল যতই মরিচা পড়ুক, সেগুলো পাল্টানো তো দূর, তার দিকে আঙুল তোলাও সমাজের চোখে খারাপ! কোনো জাতির উন্নতির পিছনে নারী নামক মানুষগুলোর ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই! চাকমা সমাজেও নারীদের ভূমিকা কত বিস্তৃত তা বিস্তারিত বলে হয়তো শেষ করা যাবে না। তবে এ অবদান যতটা না আমাদের পুরুষ মানুষদের ক্ষেত্রে স্বীকৃত, নারী মানুষদের ক্ষেত্রে তা ততটা স্বীকৃত না। বরঞ্চ তাদের এ অবদানকে বিভিন্নভাবে এড়িয়ে চলা হয়। অন্যদিকে, এসব ব্যাপারে আমাদের চাকমা নারীরাও যথেষ্ঠ উদাসীন। তাদের বেশীরভাগই এতকাল ধরে চলে আসা সমাজের নির্ধারিত কিছু নীতিকে তাদের ধর্ম হিসেবেই নিয়ে নিয়েছে! ফলে এর বাইরে চিন্তা করার ধারণাটা তারা কবে, কোথায়, কোন বনে, কোন সাগরের কোন অতলে খুইয়ে ফেলেছে সেসব তারা মনেই করতে পারবে না!
ইদানীং আমাদের সমাজে কাগজে কলমে শিক্ষিতের হার বাড়ছে ঠিকি, কিন্তু স্বশিক্ষিত হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া তেমন কাউকে চোখে পড়ে না। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে তা বেশি। আমাদের উপমহাদেশের নারীরা যেভাবে নিজের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার জন্য যুগ যুগ ধরে নানাভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছে সেরকম কোনো প্রত্যক্ষ আন্দোলন ও আমাদের চাকমা মেয়েরা তেমন একটা করেনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বিরুদ্ধাচরণ করার চিন্তাও হয়তো মাথায় আসেনি। ভারতীয় উপমহাদেশের আজকের যে মেয়েরা প্রশাসনিক কাজে কর্মরত থেকে বিশাল বিশাল দায়িত্ব পালন করছে তা তাদের একদিনে হয়নি। পথে, ঘাটে, ঘরে অসংখ্য ধাক্কা খেয়ে তারা কন্ঠ তুলেছিল অধিকার রক্ষায়। প্রথমে সবাই বুঝেনি, অধিকার কি? তাদের আদৌ কোনো অধিকার আছে না কি! কারণ তারা মেনেই নিয়েছিল নারী হয়ে জন্মালে এগুলো স্বভাবিক। পুরুষের ছায়ার তলেই তাকে থাকতে হবে চিরকাল। নিজের বলে তার কিছু থাকবে না! সে অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে একজন দুইজন করে বাড়তে বাড়তে শত মানসিক-শারীরিক আঘাত ও লাঞ্ছনা সহ্য করে যারা প্রথম গলা খুলে, কলম তুলে প্রতিবাদ করেছিল, আজ তাঁরা এ পর্যায়ে এসেছে। ‘মহিলা’ মানেই যে মহলেই জন্ম-মৃত্যু হবে, ‘গৃহিণী’ মানেই যে শুধু গৃহেই আবদ্ধ থাকবে সমাজের সেসব প্রচলিত মরিচা পড়া শিকলকে তাঁরা ভাঙতে উদ্যত হয়েছিল। যদিও এখনও অসংখ্য নারী সারা জীবন ‘হোম কোয়ারান্টাইন’ এ বন্দী থেকেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে, সে জায়গা থেকে যারা এ ঘুনেধরা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়ানোর চিন্তা করেছিল, তাদের থেকে প্রেরণা নিতে হবে। ইতিহাস বলে, অধিকার কেউ কাউকে যেচে দেয় না। অধিকার আদায় করে নিতে হয়।
তুলনামূলক বিচারে, আমাদের চাকমা সমাজে হয়তো নারীমানুষদের জন্য সতীদাহ প্রথা, যৌতুক প্রথা সহ অসংখ্য ভয়াবহ প্রথার প্রচলন নেই। তবে এসব থেকেও ভয়াবহ প্রথা হচ্ছে, চুপ করে থাকার প্রথা! আমাদের চাকমা মেয়েরা কেমন যেন চুপ! কত কিছু হয় তাদের বিরুদ্ধে! তারা চুপ! হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া! কেন চুপ করে থাকেন আপনারা? মেয়ে বলে? কিন্তু,তাহলে তো অবচেতন ভাবে সমাজের দাসত্বকে বরণ করা হলো! যদি তাই হয়, তাহলে বলছি শোনেন, মেয়ে বলে, নারী বলে চুপ করে থাকবেন না! সমাজের লোকে মন্দ বলবে বলে চুপ করে থাকবেন না, সমাজের নির্ধারণ করে দেয়া নারী জাতের ধর্মের অবমাননা হবে বলে চুপ করে থাকবেন না, স্ত্রীর ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে স্বামীর অন্যায়কে পুরুষের ধর্ম ভেবে চুপ করে থাকবেন না, আগে কোন কাজ কোনো নারী করেননি বলে আপনিও করবেন না, এরূপ ভেবে চুপ মেরে থাকবেন না। কেউ এর আগে এগিয়ে আসেনি তো কি হয়েছে, আপনি আগে কদম ফেলান, দেখবেন পিছনে অসংখ্য পা আপনাকে অনুসরণ করছে!
ডিগ্রীধারী কিছু শিক্ষিত মেয়েকেও দেখা যায়, তারা বিয়ে করে স্বামীর অন্যায়কে মাথা নত করে সহ্য করাটা স্ত্রীর ধর্ম মনে করে কিংবা এতে অদৃষ্টের দোষ মনে করে চুপ মেরে বসে থাকে!
আমি সবসময়ই বলি, আজকের যুগের চাকমা মেয়েরা তোমাদের দীপিকা পাড়ুকোন কিংবা এমা স্টোন পর্যন্ত দৌঁড়িয়ে লাভ নেই, আমাদের ঘরের মেয়ে কল্পনা চাকমাকেই আদর্শ বানান। তিনি তো পড়ালেখা শিখেই নিজেকে ক্ষান্ত রাখেননি। কিংবা মেয়ে বলে তিনি শুধু বিবাহের উপযুক্ত হওয়ার জন্যও পড়ালেখা করেননি। পড়ালেখার মহান ব্রত হিসেবে তিনি ব্যক্তিস্বার্থকে তুচ্ছ করে সামগ্রিক স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছুই পাওয়ার ছিল। তিনি যদি আজ শাসকচক্রের নোংরা চক্রান্তের শিকার না হতেন, হয়তো আমরা তাঁর উপস্থিতি আরও টের পেতাম। পরিবার সমাজের সব কানাকানি উপেক্ষা করে, জং ধরা শৃঙ্খলকে ভেঙে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বজ্ঞানে চতুর হয়ে উঠুন এবং একটি শিক্ষিত জাতি গঠনে নিজে থেকে এগিয়ে আসুন। আপনাদের ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কেউ আহবান করবে না, আসুন, জাতি আপনাদের অপেক্ষায় বলে। আপনারা নিজেরা এগিয়ে আসুন। একটি শিক্ষিত জাতি গঠনে আপনাদের ভূমিকা অনেকেই অগ্রাহ্য করতে পারে, অন্তত আপনারা নিজেদের দাম দিন, নিজেরা নিজেদের উপেক্ষা করবেন না। শিক্ষাকে কাজে লাগান বৃহৎ সেবায়। নেপোলিয়ন তো অনেক আগেই বলে গেছেন, ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দিন, আমি আপনাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব’। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা বিবেচনায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যেমন সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায় শিক্ষকদের গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তেমনি জাতির আজকের ক্রান্তিলগ্নে শিক্ষিত নারীদের এগিয়ে আসা খুব জরুরী। শিক্ষাকে শুধু হাতে-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে সামগ্রিক উন্নয়নে এর যথোপযুক্ত ব্যবহারে আপনাদের সচেষ্ট হওয়ার এইতো সময়। আপনারা এগিয়ে আসুন, কেউ বাঁধা দিলে ও তোয়াক্কা করবেন না। নিজেদের চিনুন এবং চেনান। আঙুল দিয়ে সমাজকে দেখিয়ে দিন, আপনারা নারী নামক মানুষেরা শুধু পুরুষদের যৌনতা নিবারক পুতুল নন, প্রতিদিন স্বাদযুক্ত তরকারি রান্না করার সমাজস্বীকৃত রাঁধুনিও আপনারা নন, আপনারা জাতির ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন! সে ক্ষমতা আপনাদের আছে!
এখনও আমাদের চাকমা সমাজে নারীদেরকে অতটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। হয়তো সব নারীরাও গুরুত্ব পাওয়ার মত তেমন মন মানসিকতা পোষণ করেন না। তাই বলছি, আপনারা আগে নিজেদের চিনুন, আত্মপরিচয়ে হোক আপনাদের পরিচয়!
লেখক: তুফান চাকমা, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন